| |
               

মূল পাতা সফর খালি পকেটে বিশ্ব ভ্রমণ!


খালি পকেটে বিশ্ব ভ্রমণ!


এসএন জিকু     17 March, 2021     01:39 PM    


পিটার হচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্রের একজন পর্যটক। তার পুরো নাম Feudie Mravenicz Petr। তার বাড়ি রাজধানী প্রাগ থেকে প্রায় 100 কিলোমিটার দূরে জেচিন (Jicin) নামের একটি ছোট্ট শহরে। পিটারের সাথে আমার দেখা হয়েছে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে।

রামুতে আমাদের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। সেই রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যার দিকে আমি বসে আছি, হঠাৎ বাইরে দেখলাম একজন বিদেশী কী যেন খুঁজছেন। একজন ওয়েটার গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কী চান? পিটার ইংরেজিতে বলল, যার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এরকম-  ‘ভাত এবং ভাতের সাথে মুরগির মাংস অথবা গরুর মাংস হবে?’ ওয়েটার সম্পূর্ণ বুঝতে পারলো না। আমি গিয়ে বললাম, আছে আপনি বসুন।
 
এরপর পিটারকে খাবার পরিবেশ করা হলো। দেখলাম পিটার খাচ্ছে চামচ দিয়ে, কোনওরকম কষ্ট করে। স্ট্রাগল করতে হচ্ছে। লক্ষ করলাম পিটার বেশ ক্লান্ত। আমি ভেবেছিলাম পিটার হয়তো ক্রিকেট কোচ, আশেপাশে কোথাও প্রেকটিস করায়। কিন্তু আমার কেন যেন জিজ্ঞেস করতে মন চাইল, এই যেমন পিটার কোথায় থেকে এসেছে, কী করে ইত্যাদি। আমি অপেক্ষা করছিলাম পিটারের খাওয়া কখন শেষ হবে। কিছুক্ষণ পরে পিটারের খাওয়া শেষ হলো। শেষ করেই মোবাইলটা নিয়ে কী যেন বলছে নিজে নিজে। আমার মনে হলো কারো সাথে হয়তো হোয়াটসএপে কথা বলছে।

পরবর্তীতে পিটারের সাথে কথোপকথন করে জানতে পারলাম পিটার একজন সোলো ট্রাভেলার। একাকী সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছে। পিটার ইতোমধ্যে প্রায় ৫৮টি দেশ সফলভাবে ভ্রমণ করেছেন। তিনি ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন।

আমরা অনেকেই মনে করি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ছাড়া পৃথিবী ভ্রমণ করা সম্ভব না, কিন্তু কেউ যখন শূন্য হাতে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে,  তখন তাকে দেখে আমাদের অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত।

পিটার সচরাচর ভ্রমণের সময় হোটেলে ওঠেন না। প্রথম যখন পিটার আমাকে বললেন যে, তিনি হোটেলে থাকেন না। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে তিনি বললেন, তিনি সত্যিই হোটেলে ওঠেন না। যেখানে রাত হয় তিনি সেখানেই ক্যাম্প করে থাকেন। এই যেমন বন জঙ্গলে, রাস্তার ধারে, স্টেশনের পাশে বা বাসাবাড়ির ছাদে অথবা খোলা মাঠে। সেইজন্য তিনি সাথে সব ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাকপ্যাকে বহন করে সঙ্গে নিয়ে চলেন। তার সেই ব্যাকপ্যাকের ওজন প্রায় ১৫ কেজি।

পিটারের সাথে কথা বলে যে অদ্ভুত বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে সেটি হলো, পিটার ভ্রমণের সময় কোনও ধরনের ট্যাক্সি, ট্রেন বা বাস ব্যবহার করেন না। তিনি রাস্তার পাশে দাঁড়ান এবং ট্রাক থেকে লিফ্ট নেন। এভাবে তিনি অধিকাংশ দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করেছেন।

বিষয়টি আমার তখনও বিশ্বাস হয়নি। পরে যখন আমরা রামুর প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরগুলো দেখা শেষ করে বাকখালী নদীর পাশ ধরে হেঁটে হেঁটে নাইক্ষ্যংছড়ি রোডে উঠি, কিন্তু সেখান থেকে রামু চা-বাগানের দূরত্ব তখনও প্রায় ২ কিলোমিটার ছিল। আমি পিটারকে বললাম, চল আমরা টমটম বা অটো নিই। পিটারের চোখে একটা না না ভাব লক্ষ করলাম। (মনে হয় টাকা খরচ করতে আগ্রহী না কিন্তু আমি আশ্বস্ত করলাম যে ভাড়া আমি দিব)। তারপরও আমি দূরে তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তায় কোনও গাড়ি আছে কিনা। রাস্তায় কোনও গাড়ি দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরেও কোনও গাড়ি দেখতে পেলাম না। পরে আমরা হেঁটে হেঁটে রওনা দিই। হেঁটে কিছুটা আসার পর দেখলাম, একটা মিনি ট্রাক আসছে। পিটার সেই ট্রাকটাকে ইশারা করে সিগনাল দিলো। দিব্যি ট্রাকটা দাঁড়াল। আমি তখনও পিছনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পিটার আমাকে বলল, আমি যেন আগে উঠি। দুইজন মিলে উঠে বসে পড়লাম সেই ট্রাকে। মাঝ পথে এসে পিটার একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমাকে বলল This is how I travel. আমি কোনও উত্তর দিলাম না। সত্যি বলতে কি আমি তখন একপ্রকার লজ্জায় পড়ে গেলাম!

প্রথম দিকে বলেছিলাম পিটার খাবার শেষ করে কার সাথে যেন হোয়াটসএপে কথা বলছে। সত্যিকার অর্থে বিষয়টি তেমন ছিল না। পরে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সেইটা হোয়াটসএপে কথোপকথন ছিল না। সে সময় তিনি তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করছিলেন। তিনি যখন কোনও নতুন এলাকায় ভ্রমণ করেন তখন তিনি সেই ভ্রমণের গল্প লেখার পরিবর্তে ফোনে রেকর্ড করে রাখেন। তার মতে রেকর্ড করাটা লেখার চেয়ে সুবিধাজনক, এতে সময় বাঁচে।

পিটারকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার কাছে বাংলাদেশি সিম কার্ড আছে কিনা। পিটার নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, তার কাছে সিম কার্ড বা ইন্টারনেট কেনার মতো যথেষ্ট টাকা নেই। পিটার সপ্তাহে এক বা দুইবার ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়।

আচ্ছা পিটার, বুঝলাম তোমার না হয় থাকতে হোটেল লাগে না বা যাতায়াতের জন্য বাস/টেক্সি লাগে না। কিন্তু তুমি জীবিকানির্বাহের জন্য বা বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করার জন্য ভিসা ফি ও খাবার খাওয়া জন্য টাকা কোথায় থেকে পাও? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

পিটার অকপটে উত্তর দিলেন, তিনি কোনও চাকরি করেন না। যখন তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন তখন তিনি সেই দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি তোলেন এবং সেই ছবিগুলো প্রিন্ট করে চীন, কোরিয়া বা মালয়েশিয়া অথবা অন্য দেশে বিক্রি করেন। তিনি সাধারণত ভ্রমণের আনুষাঙ্গিক খরচগুলো এইভাবেই মেটান।

পিটারকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি যে রাতে খোলা মাঠে থাকবে তোমার কি পর্যাপ্ত গরম কাপড় আছে? পিটার বলল, আছে কিছু। তবে বিষয় কি জানো? তোমাদের দেশে উইন্টারে যেরকম শীত পড়ে আমাদের দেশে সামারে এর চেয়ে বেশি শীত পড়ে!

কেউ যদি দেশে বিদেশে নতুন নতুন স্থান ভ্রমণ করার স্বপ্ন বুকে লালন করেন, তাহলে সেই স্বপ্নকে লালন না করে বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করুন। অবশ্যই সেই চেষ্টা সফল হবে। হ্যাপি ট্রাভেলিং!