মূল পাতা জাতীয় নির্বাচন কমিশন আরপিও কী? এটি কী নির্বাচনে অনিয়ম- কারচুপি ঠেকাতে সক্ষম?
রহমত নিউজ ডেস্ক 21 November, 2023 01:32 PM
নির্বাচন বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, সংবিধানের আওতায় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যতগুলো আইন আছে তার মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত মূল আইন হলো আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তীতে সংবিধান তৈরির পর নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রথমবারের মতো আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ প্রণয়ন করা হয়েছিলো। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে এ আইনটিতে। সবশেষ চলতি বছর সংসদে পাশ হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আদেশ ২০২৩ আইনটি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী বলেছেন, নির্বাচনের জন্য দেশের মানুষের গণঅধিকার কোনগুলো এবং এ অধিকার রক্ষায় নির্বাচন কমিশন কী করবে সেটিই বলা হয়েছে আরপিওতে। এর ১৪৫টি ধারার মধ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত সব বিষয় বর্ণনা করা আছে। এর মাধ্যমে বলা আছে যে কীভাবে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে।
নির্বাচন বিষয়ক বিশ্লেষক এবং বেসরকারি সংস্থা সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, দেশে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো আইন থাকলেও নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে মূল আইন হলো আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ। এ আইনটি ঠিকমতো প্রয়োগ করার মাধ্যমে নির্বাচন সঠিকভাবে করা সম্ভব কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয় না।
সংবিধান, আরপিও এবং অন্য আইন
বিশ্লেষকরা বলছেন নির্বাচনের মূল ভিত্তি সংবিধান। সেই সংবিধানের অধীনেই করা হয়েছিলো গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার ১৯৭২) , যা এ পর্যন্ত অনেকবার সংস্কার হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই বছরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছিলো এ আইনে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন, প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয় নিরূপণ কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীকে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো সে সময়ে সংযোজিত হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আলাদা আইন থাকায় এ আইনটিকে অবশ্য শুধুমাত্র সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবার কথা বলে থাকেন অনেক বিশ্লেষক। যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচন এখন দলীয় ভিত্তিক হওয়ায় আরপিও আইনটি সেখানেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর বাইরে ভোটার তালিকা, ইভিএম কিংবা সীমানা নির্ধারণের মতো আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাদা আইন আছে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন যে আইনের আওতায় নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করে সেটিই হলো আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা কখনোই এর যথাযথ প্রয়োগ করেনি। ২০১৮ সালে ভোটের নামে যে নির্বাচনী অপরাধ হয়েছে তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরপিও’র অধীনে বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিলো। কিন্তু কমিশন তা করেনি।
নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকাতে সক্ষম আরপিও?
আরপিওর ৭৩ থেকে ৯০ ধারা পর্যন্ত নির্বাচনী বিভিন্ন অপরাধের জন্য কি কি শাস্তি আছে তার উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো নির্বাচনের মাঠে এগুলোর প্রয়োগ কমই হয়। সাবেক নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী এবং সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার উভয়েই বলছেন, আরপিও যথাযথ প্রয়োগ হলে সেটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সক্ষম।
জাবেদ আলী বলেন, আইনের মাধ্যমে যেন সব অনিয়মের প্রতিকার করা হয় সেজন্যই তো আরপিও। কোন অনিয়ম হলে নির্বাচন স্থগিত করতে পারে কমিশন। এমনকি তদন্ত সাপেক্ষে বাতিলও করতে পারে।
গত বছর অক্টোবরে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার একটি আসনে উপনির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপির দৃশ্য দেখার পর আরপিও আওতায় ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচনটি বাতিল করেছিলো নির্বাচন কমিশন। তবে সেই নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি উপ-নির্বাচনে একজন প্রার্থী নিখোঁজ হয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশন কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি- এমন উদাহরণও আছে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে দুটি উপ-নির্বাচনে ব্যালটে সিল মারার দৃশ্য ভাইরাল হলে কয়েকটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে কমিশন। এসব নির্বাচনেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে গত প্রায় এক দশকে এমন অনেক নির্বাচন হয়েছে যেখানে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠলেও আরপিও যথাযথ প্রয়োগ না করার অভিযোগ আছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কমিশন আরপিওর আওতায় পাওয়া ক্ষমতাবলে কোন ব্যবস্থা নিলেও তা অমান্য করার উদাহরণ আছে এবং সে ক্ষেত্রে অমান্যকারীর বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সবশেষ নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলেও তিনি সেটা করেননি। কিন্তু পরে কমিশন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি।
বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার বহু মানুষের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন ভঙ্গের মতো অপরাধের অভিযোগ উঠেছিল। আরপিও যথাযথ প্রয়োগ করলে তাদের শাস্তি দেয়ার ঘটনা ঘটতো, কিন্তু সেরকমটা দেখা যায়নি।
সংশোধনের পর আরপিও
চলতি বছর সংসদে পাশের পর আইনে পরিণত হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আইন, ২০২৩। আইনটি পাশের পর এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। অনেকে অভিযোগ করেছিলেন যে আইনটি সংশোধন করে সরকার কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করেছে। জুলাই মাসেই নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আইন, ২০২৩ এর কিছু বিষয় সম্পর্কে জনমনে স্পষ্ট ধারণা দিতে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। মূলত আরপিও সংশোধনী নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার প্রেক্ষাপটে কমিশন যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিলো সেগুলোর প্রতিটির বিষয়ে ওই বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা ও নিজেদের বক্তব্য দিয়েছিলো। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়ে গেলে গেজেট করা ছাড়া আগে কমিশনের আর কোন ক্ষমতা ছিলো না। আর ফলাফল গেজেট হলে প্রার্থীদের আদালতে যাওয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু সর্বশেষ সংশোধনীর ফলে কমিশন প্রয়োজন মনে করলে ফলাফল গেজেটে প্রকাশ করাই স্থগিত রাখতে পারবে।
আগে নির্বাচন কমিশনের তদন্তের সুযোগ ছিলো না। কিন্তু এখন তদন্তের সুযোগ আছে এবং সে তদন্তের ওপর ভিত্তি সঙ্গত মনে করলে যেসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ফল বাতিল করতে পারবে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে দুটি উপ-নির্বাচনের ফল ঘোষণা স্থগিত করে তদন্ত করেছিলো নির্বাচন কমিশন। পরে উভয় আসনের কয়েকটি কেন্দ্রর ফল বাতিল করা হয়। এছাড়া এই আইনে থাকা বিধান বলে অনিয়ম হলে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা আছে নির্বাচন কমিশনের। সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। তবে এর সঙ্গে একটি উপধারা যোগ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যে কেন্দ্রে গোলযোগ বা জবরদস্তি হবে শুধু মাত্র সেই কেন্দ্রেরই ভোট বন্ধ করা যাবে। নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য হলো, এর ফলে কোন আসনে যদি বেশিরভাগ কেন্দ্রে অনিয়ম বা গোলযোগ হয় তাহলে সেগুলোতে নির্বাচন বন্ধ করে দিলে স্বাভাবিকভাবে পুরো আসনের নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাবে।
যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন, আরপিওর অনেক কিছু কমিশন নিজেই প্রয়োগ করে না বলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় না। যেমন নির্বাচনে কারা যোগ্য সেটি যাচাইয়ের জন্য হলফনামা দেয়ার পদ্ধতি আছে আইনে।
বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে অযোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচন থেকে দূরে থাকতো। নির্বাচন কমিশন আরপিও যথাযথ প্রয়োগ না করার সুযোগ নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদল/ছাত্রলীগের মতো ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কিংবা বিদেশে দলের শাখাগুলো পরিচালনা করে যাচ্ছে।