রহমত নিউজ 10 August, 2023 09:57 AM
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন করে সরকার ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে এই আইন সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনেরা এতদিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, তা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে সরকার যে আইন করার ঘোষণা দিয়েছে, তা শেষপর্যন্ত কী দাঁড়ায়, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছে। বুধবার (৯ আগস্ট) দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সই করা এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের উদ্বেগ আমলে নেয়নি। সেই আইন সংশোধন, বাতিল বা নতুন আইন করার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও তাদের মতামত নেওয়া হবে, সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সে রকম কিছু না করেই সরকার প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি এবং তা আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ জনমনে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর ভাষ্য থেকে সংবাদমাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সম্পাদক পরিষদ শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। কারণ, কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি কমানো এবং অজামিনযোগ্য কিছু ধারা জামিনযোগ্য করা ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১ ও ৩২ ধারাগুলো অজামিনযোগ্য ছিল। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এসব ধারা জামিনযোগ্য থাকছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলে, শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা হবে অর্থহীন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের শাস্তি কারাদণ্ডের বদলে ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধানের কথা বলা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর অধীনে মানহানির দায়ে যে শাস্তির বিধান আছে, সেটা সংশোধন না করা হলে নতুন বিধান অকার্যকর হতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, ২৫ লাখ টাকা জরিমানা শোধ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত কারাদণ্ডই ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যে অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে বিধিবিধান আছে; তার পরিবর্তে এসব শাস্তির বিধানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ধারা দুটি বাতিলের পক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালো দাবি ওঠে। নতুন আইনে শাস্তি কমিয়ে এই দুটি ধারা রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকে যাবে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাটি রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ধারার মাধ্যমে শাস্তির মাত্রা কিছু কমানো হলেও ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে সন্দেহ করত বলে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন থাকার কোনো যুক্তি আছে বলে সম্পাদক পরিষদ মনে করে না।
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী, পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার ক্ষমতাবলে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারে। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত একধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারাটিও যেহেতু বহাল থাকছে, তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। এছাড়া সরকার যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু এই আইনে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার এবং এই আইনে যারা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেছেন, তাদের মুক্তি দেওয়া হোক।