রহমত নিউজ ডেস্ক 29 June, 2023 05:26 PM
“মাংস পামু কই? মাংস পাইলে কি আর তুলবার আইছি?” গুলশানের রাস্তায় বসে কাঁদতে কাঁদতে একথা বলছিলেন মালেকা। কুড়িল বস্তিতে বাড়ি তার। ঈদ-উল আজহা উপলক্ষ্যে বিলিয়ে দেয়া কোরবানির গরুর মাংস তুলতে এসেছেন তিনি। ঈদের সকালে ঝুম বৃষ্টির জেরে যখন রাস্তায় বের হওয়াটাই দায়, তখন এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েও মালেকার মতো একদল মানুষ এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দরজায় গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ‘মাংস হইছে’? গেটের ওপার থেকে উত্তর আসে, ‘হয় নাই’, ‘পরে’, ‘বিকেলে আসেন’। অবশ্য রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা মানুষগুলো নিরাশ হলেও হাল ছাড়েন না। হাঁটতে শুরু করেন পরের বাড়ির গেটের উদ্দেশ্যে। হবেই বা না কেন? মূল্যস্ফীতির কারণে জীবন যাত্রার ব্যয় যেখানে আকাশ ছোঁয়া সেখানে ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষ্যে কোরবানি দেয়া পশুর মাংসই অনেক নিম্ন আয়ের মানুষদের মাংস খাওয়ার একমাত্র উৎস। তাই এই দিনটিতে বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেও মাংস তুলতে বের হন অনেকে।
মালেকার এই যাত্রায় তার কাছে গিয়ে যখন বলি আমি আপনাদের সাথে ঘুরতে চাই কিছুক্ষণ, এটা শুনে বেশ আগ্রহের সাথেই রাজি হয়ে গেলেন। আমার ছাতার নিচে মালেকা আর আমি। আর আমাদের পাশে ভাঙা একটা ছাতা মাথায় মোসাম্মত জেসমিন। স্বামী আর ছোট দুই ছেলে মিলে সংসার মালেকার। আজ যেহেতু ঈদ তাই সকালে সেমাই রান্না করে বেরিয়ে পড়েছেন মাংসের সন্ধানে। তার আগে খেয়ে এসেছেন গতকাল রান্না করা ভাত, ডাল আর আলুভর্তা। মাংস নিতে কেন বের হয়েছেন জানতে চাইলে মালেকা বলেন, গত রোজার ঈদে একবার গরুর মাংস খেয়েছিলেন। এরপর আর কেনার সামর্থ্য হয়নি। সংসার চলে প্রধানত তার আয়েই। কারণ স্বামী অসুস্থ হওয়ায় খুব বেশি কাজ করতে পারে না। তিন হাজার টাকা ঘর ভাড়া দেই, এরপর আর বাজার করার জন্য কয় টাকা হাতে থাকে আপা কন? জিনিসপত্রের যে দাম! মাংস কিনবো ক্যামনে? ৮০০ টাকা কেজি।
এমন গল্প করতে করতে পরের বাড়ির গেটে গিয়ে জানা গেলো আরো আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করলে তারপর মিলতে পারে মাংস। মিজ মালেকা আর মিজ জেসমিন সিদ্ধান্ত নিলেন, এই আধাঘণ্টা ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করবেন। মিজ মালেকা বের হয়েছেন সকাল এগারোটার দিকে। এরপর দেড় ঘণ্টার মতো পেরিয়ে গেছে। ৫০-৬০টি বাড়িতে ঘুরেছেন। এরইমধ্যে কাকভেজা তিনি। তবে তখনও পর্যন্ত কোথাও থেকে মাংসের সন্ধান করতে পারেন নি। তাই এই সিদ্ধান্ত। বলতে বলতে গলা ধরে এলো মালেকার। চোখের কোণে পানির কয়েক ফোঁটা বাঁধ ভেঙে বেরিয়েও এলো। মালেকার পাশের মোসাম্মত জেসমিন সান্তনা দিতে এগিয়ে গেলেন। এরা কেউ কাউকে আগে থেকে না চিনলেও ঈদের এই মাংস সংগ্রহে এসে পরস্পরের যেন নিকটাত্মীয় হয়ে গেছেন। “কষ্টে থাকলে মুখ দিয়া ‘আও’(আওয়াজ) আহে না। মাংস পামু কই? মাংস পাইলে কি আর তুলবার আইছি?” বলেন মালেকা।
মোসাম্মত জেসমিন থাকেন মহাখালী সাততলা বস্তিতে। চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার তার। পেশায় দিনমজুর স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে মাংস কুড়াতে বেরিয়েছেন। বেলা প্রায় একটার দিকে কতটুকু পেয়েছেন জিজ্ঞেস করলে, সাথে করে নিয়ে আসা নীল রঙের পলিথিন ব্যাগটি তুলে ধরে বলেন, “টুপলা(ব্যাগ) খালি। যেনে যাই, হেনেই খালি কইতেসে পরে পরে পরে। সন্ধ্যে পর্যন্ত থাকার পরিকল্পনা আছে তার। মিজ জেসমিন বলেন, “দেখি আল্লাহ কতক্ষণ রাখায়। বলতে পারি না কেডা কোনসুম দেয়, যেখানে দেয়া ধরবো, ওইখানেই দৌড় দিমু। হাইটা হাইটা জানা লাগবো কুন জায়গায় দেয়। এই যেমন এই বাসায় আইছি বলছে পরে। ওই পরের আশা কইরা আরেক জায়গায় যাই। আরেক জায়গায় গেলেও পরে। এইরকম করতে করতে যে জায়গায় গিয়া কপাল ঠেকে। আশা করছেন দিন শেষে আধা কেজি থেকে এক কেজির মতো মাংস হয়তো জোগাড় করতে পারবেন। আর সেই মাংস বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরই বাচ্চারা ঈদে মাংসের স্বাদ পাবে। ঈদ তো, সেমাইটা রান্না করছি। পানি ভাত ছিল, ডিম ভাইজ্যা খাওয়া-দাওয়া কইরা বাইর হইছি। আর কিছু রান্দি নাই। কেনার টাকা পামু কই?
জেসমিন বলছেন, যদি কুড়িয়ে মাংস না পান - তাহলে বিকেল বেলা কুড়ানো মাংসের যে হাট বসবে সেখানে গিয়ে বাচ্চাদের জন্য আধা কেজি মাংস কিনবেন তিনি। কারণ সেটি সাধারণ বাজারের তুলনায় সস্তা। কিনতে গেলেও তো হেই বিকালে। মানুষ টুকায়া-টাকায়া নিবো, কেউ নিয়া থুইবো, তারপরে কিনতে হইবো।
জেসমিন আর মালেকার সাথে গল্পের কিছুক্ষণ পরেই আরেকটি দল আসলো যারা মাংস কুড়াচ্ছেন। ৫-৬ জন নারী আর ৪-৫ জন পুরুষের এই দলটি বেশ বড়। কেউ কাউকে না চিনলেও দলবদ্ধ হয়েই মাংসের সন্ধান করছেন তারা। এই দলটির একাধিক সদস্যের সাথে কথা হয়। এর মধ্যে কয়েক জন নারী রয়েছেন। তারা জানালেন সকাল ৯টার দিকে বেরিয়েছেন তারা। এরই মধ্যে এদের কয়েক জন আধা কেজি থেকে শুরু করে পৌনে এক কেজির মতো করে মাংস পেয়েছেন। কথা বলতে বলতে বৃষ্টির জোর বাড়তে থাকে। মাংস কুড়াতে আসা এই মানুষগুলোর সেদিকে খেয়াল আছে বলে মনে হলো না।
এই দলটির বেশিরভাগেরই বাসা বাড্ডা এলাকায়। এদের মধ্যে একজন নাজমা। সকাল নয়টায় এসে, বেলা দেড়টা পর্যন্ত অনেকগুলো বাড়ি ঘুরেছেন জানিয়ে বলেন, প্রায় আধাকেজির মতো মাংস পেয়েছেন তিনি। দিন শেষে দুই-তিন কেজির মতো পান বলে জানালেন। সবটুকু মাংসই নিজেদের জন্য রেখে দেন। পোলাপাইনে খাইতে চায়। না হইলে ঈদে ভাত খাইতে চায় না। সকালে শুধু সেমাই ছাড়া কিছু রান্না করেননি, বাজারের টাকা পয়সা তো থাকা লাগবো রে বাবা, আমরা তো গরীব মানুষ। গরীব মানুষ না হইলে কি রাস্তায় বাইর হইয়া আসি?
কথা বলতে দেখে সামনে এগিয়ে আসলেন আনোয়ারুল ইসলাম। পেশায় তিনি রিক্সাচালক। তার হাতের সাদা চটের ব্যাগটি তখনো খালি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তার প্রস্তুতি শুধু মাথায় একটা গামছা বাঁধা। ঈদ আসলেও পরিবারের জন্য মাংস বা অন্য কোন বাড়তি বাজার করতে পারেননি তিনি। বাবা-মা, ভাই-বোন আর স্ত্রী সন্তান নিয়ে আট-নয় সদস্যের পরিবার চলে তার একার আয়ে। শেষ কবে গরুর মাংস খেয়েছেন সেটা বেশ কষ্ট করেই মনে করতে হলো তার। আটশ, সাড়ে আটশ টাহা কেজি। আমগো মতো রিশকা চালায় যারা - তারা কি কিনতে পারবো?
আলি আকবর-তিনিও একজন রিক্সাচালক। আকবর জানান, জীবনে প্রথমবার মাংস কুড়াতে বের হয়েছেন তিনি। বাজারের যে পরিস্থিতি, সব জিনিসপত্রের দাম বেশি, তার সাথে পাল্লা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে তার। এক ছেলে আর এক মেয়ের সংসারের এই ঈদে বাচ্চাদের সেমাইও মুখে তুলে দিতে পারেননি। সিমাইও জোটেনি, সিমাই- তাও জোটেনি। কথা বুঝতে পারছেন? কষ্টে... যার কারণে বের হইছি এখন। এক কেজি গোশ কিনতে গেলে ৮০০-১০০০ টাকা লাগবে। আমরা যারা রিশকা চালাই, তাদের কাছে তো আর সম্ভব না, বড়লোকরা যদি হেল্প না করে।” সকাল থেকে গুলশানের বিভিন্ন এলাকায় শ’খানেক বাড়িতে ঘুরেছেন তিনি। দুপুর পর্যন্ত কোন মাংস পাননি। কিন্তু ঘরে বউ আর সন্তানদের বলে এসেছেন মাংস নিয়ে ফিরবেন তিনি। আর তিনি ফিরলে তবেই হাঁড়ি উঠবে চুলায়। আড়াই ঘণ্টা ধরে ঘুরতেসি, এখনো এক টুকরা মাংসের সন্ধান পাইনি, ঠিক আছে। কখন পাবো, কখন বাসায় নিয়া যাবো, আমার বউকে বইলে আসছি, আমি আসি, তারপর রান্না করবা। যেখানে যাই সেখানে বলতেছে পরে হবে, পরে হবে। আল্লাহ যদি লিখে রাখে দুই-এক পিস, তাহলে হলে হবে, না হলে নাই। ভাগ্যের উপর নির্ভর। আধা ঘণ্টা পরে মাংস পাওয়ার আসায় যে বাড়ির গেটের বাইরে আলি আকবররা দাঁড়িয়েছিলেন, প্রায় ঘণ্টাখানেক সেখানে থেকে ফিরে আসছিলাম আমি। আর তারা তখনো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। জোর বাড়ছিলো বৃষ্টিরও।
সূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা