রহমত নিউজ ডেস্ক 16 January, 2023 06:03 PM
বাংলাদেশে ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর জন্য সরাসরি অসংক্রামক রোগ-এনসিডি দায়ী বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অসংক্রামক রোগের প্রভাবে মানব জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, কেননা এর দ্বারা সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যতেই সীমাবদ্ধ নয়। এ সকল রোগের কারণে মানুষ দারিদ্রের চক্রে আটকে যায় এবং তাদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।
সোমবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন আয়োজিত ‘উচ্চ রক্তচাপ, সিডিডি এবং ডায়াবেটিস: আসন্ন পঞ্চম স্বাস্থ্য খাতের কর্মসূচির দিকে পদক্ষেপ’ শীর্ষক জাতীয় গোলটেবিল আলোচনাসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের সভাপতিত্বে সভায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস ফোরাম-বিএনসিডিএফ সভাপতি অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে গোলটেবিল বৈঠক শুরু করেন। গোলটেবিল আলোচনায় মূল বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ-এনসিডিসি শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের সিইও ডা. শামীম হায়দার তালুকদার।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, অসংক্রামক রোগের প্রভাবে কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে, ফলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আশঙ্কার মুখে। হৃদরোগ দেশে অসংক্রামক রোগের তালিকার শীর্ষে রয়েছে এবং এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগ বাংলাদেশে মৃত্যুহার, অসুস্থতা এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রধান কারণ। উচ্চ রক্তচাপ, সিভিডি এবং ডায়াবেটিসের বর্তমান পরিস্থিতির পাশাপাশি চলমান কর্মকাণ্ডের সাফল্য এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রস্তাবিত পদক্ষেপের বিষয়ে তাদের আলোচনার সময়, তারা হাসপাতালে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস সেবাকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন। এছাড়াও, তারা শহুরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাগুলোতে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের যত্নের মান উন্নত করতে আগামী ৫ বছরের স্বাস্থ্যখাতের কর্মসূচিতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারকে আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশের জন্য কার্ডিওভাসকুলার রোগ দায়ী। একইভাবে, বাংলাদেশের শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলেই ডায়াবেটিসের উচ্চ প্রকোপ রয়েছে, যার শতকরা হার ৪.৫ শতাংশ থেকে ৩৫.০ শতাংশ পর্যন্ত। অসংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে সবার আগে স্মোকিং অ্যাভোয়েড করতে হবে। যদিও স্মোকিং নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন করা হয়েছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি। আইনটা ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে। এছাড়াও আমাদেরকে চিনি খাওয়া কমাতে হবে। প্রতিদিন ৬ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া যাবে না। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। আমরা এক্সারসাইজ করি না। গ্রামেও এখন মানুষ রিকশা, ভ্যানে চলাচল করে। স্কুলে স্কুলে গিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের অনেক মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষক নেই, এটি পূরণ করতে হবে। চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইমার্জেন্সিতে কোনো রোগী আসলে কী ওষুধ, এটা প্রতিটি হাসপাতালেই থাকা উচিত। যখন যেই চিকিৎসকই দায়িত্ব পালন করবে, সেটি সেই চিকিৎসক অনুসরণ করবে। স্ট্রোকে তিন ঘণ্টার মধ্যে আসলে একটা ইনজেকশন দিলেই সে সুস্থ হয়ে বাড়ি যেতে পারবে। এটাকে আরও সহজলভ্য করতে হবে। যদি পারতাম হাঁটাহাঁটিকে আইন করে দিতাম। অফিস থেকে বেড়িয়ে বাসে, রিকশায় না চড়ে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। তাহলে অসংখ্য রোগ থেকে এমনিতেই বাঁচা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো আমাদের রোগীদের ন্যাশনাল কোনো রেজিস্ট্রি নেই। রোগের অ্যাকচুয়াল কোনো ডাটা নেই। এটি অনেক বড় সমস্যা। তবে সম্প্রতি এনসিডিসি থেকে স্ট্রোকের রেজিস্ট্রি শুরু করেছি। আমাদের সমস্ত হাসপাতালে ইমার্জেন্সি রুম আছে, ইমার্জেন্সি চিকিৎসা নেই। কার্ডিয়াক এরেস্টে চলে গেলে ঠিকমতো সাপোর্ট দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা ডাক্তারদেরই ভালো করে এখনও শিখাতে পারিনি। ২০১৮ সালে মাত্র ২টি উপজেলায় এনসিডি কর্নার ছিল, এখন তিন শতাধিক এনসিডি কর্নার আমাদের আছে। এটি হওয়ায় নানা সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা স্পেসিফিক করে বলতে পারছি হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসে বছরে কতো রোগী আসছে, চিকিৎসা নিচ্ছে। চিকিৎসায় আমাদের পকেট খরচ দ্রুত কমে যাবে যদি গাইডলাইন ফলো করি। প্রটোকল ফলো করে সবচেয়ে কম খরচে কোভিড চিকিৎসা হয়েছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে কিন্তু মৃত্যু কমাতে পারেনি অনেক হাসপাতাল, কারণ তারা প্রটোকল ফলো করেনি। অসংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে আমাদের বিহেভিয়ার চেঞ্জ করতে হবে। আমরা যে পরিমাণ লবণ খাই, খুবই ভয়াবহ। ফাস্ট ফুড খাওয়া কমাতে হবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম এ মালেক বলেন, হাইপারটেনশন, ধূপমান, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমাদের জাতিকে সুস্থ রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের তুলে ধরতে হবে। বৈশ্বিকভাবে আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজে বসবাস করছি, এই বিশ্বে টিতে থাকতে হলে আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। সুস্থ থাকলে হলে অবশ্যই প্রিভেনশনে গুরুত্ব দিতে হবে। বারবার প্রিভেনশনের কথা বলতে হবে। সবাইকে মিলে কাজ করতে হব।
অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বলেন, আইডিএফ ডায়াবেটিস অ্যাটলাসের মতে, ৮.৪ মিলিয়নেরও বেশি ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে বলে অনুমান করা হয়েছে এবং অনুরূপ সংখ্যক মানুষ টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন; যার কারণে ডায়াবেটিসের প্রকোপ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুস্থ জীবনযাপনে হেলদি ডায়েট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সমাজে সুস্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। এই জায়গায় চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বলেন, রোগীরা তাদের কথা শুনতে চায় না, তাদের পরামর্শ মেনে চলে না। এক্ষেত্রে আমি বলবো যে, রোগীদের যে কৌশলে পরামর্শ দিলে মানবে, সেটি আপনাদেরকে রপ্ত করতে হবে।