মূল পাতা আরো পাঠকের কলাম ইতিহাস-ঐতিহ্যে খেলাফত আন্দোলন এবং হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.
মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী 28 November, 2022 04:59 PM
পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়ার বুকে খেলাফতে এলাহিয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন। আর যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম মানব সৃষ্টির এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে অর্থাৎ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান তথা আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালন করেন। আম্বিয়ায়ে কেরামের পর তাদের উত্তরসূরী ওয়ারেসানে নবী উলামায়ে কেরাম এ ধারা অব্যাহত রাখার নেতৃত্ব দেন। আকাবিরদের সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববরেণ্য বুযুর্গ হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ: এর অন্যতম খলিফা, উপমহাদেশের বিশিষ্ট বুযুর্গ আমীরে শরীয়ত আল্লামা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ: মানব জাতির মূল দায়িত্ব খেলাফতে এলাহিয়া প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে।
অনেকে মনে করেন হাফেজ্জী হুজুর হঠাৎ করে রাজনীতিতে এসে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছিলেন, এ কথা সঠিক নয়। কারণ তদানীন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান আইয়ুব খান থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত প্রায় সকল রাষ্ট্রনায়ককেই শুভাকাঙ্ক্ষা মুলক উপদেশ এর মাধ্যমে দেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা এবং এ দায়িত্ব উপেক্ষা করার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন পত্রের মাধ্যমে তিনি। কখনও সাক্ষাতে পরামর্শ দিয়ে নসীহত করেছেন। শাসকরা ইসলামী হুকুমত কায়েম তো দূরের কথা অনৈসলামিক কার্যকলাপও বন্ধ করতে পারেননি। যখন ওলামায়ে কেরামরা লাঞ্ছিত-অপমানিত হচ্ছিল,কোন আলেমের রাজপথে দাঁড়িয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলার সাহস ছিলোনা। ঠিক তখনই হাফেজ্জী হুজুর রহ: তওবার ডাক দিয়ে সরাসরি সক্রিয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন এবং ১৯৮১সালে ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে সরকারি হিসেবে (প্রায় ৫০জন প্রার্থীর মধ্যে) তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। নির্বাচনে অভূতপূর্ব জাগরণ ও বিস্ময়কর সাফল্যের রেকর্ড সৃষ্টি হয়। যা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ও থাকবে।
সেই ১৯৮১ সনেই ২৯ নভেম্বর লালবাগ শায়েস্তা খান হলে অনুষ্ঠিত তাঁর নেতা-কর্মীদের সম্মেলনে প্রতিষ্ঠা করেন "বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন" নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাইয়ের মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ মোঃ ফজলুল করিম এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনী সাহেব রহ: ছিলেন হাফেজ্জী হুজুর (রহ)-এর ছাত্র ও মুরীদ। তিনজনকেই তিনি খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর নিযুক্ত করেন । জমিয়ত নেতা মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী, শীর্ষ আলেম মাওলানা শাহ ফয়জুর রহমান, মাওলানা আবুল হাসান যশোরী, মুফতি ইউসুফ ইসলামাবাদী ও মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহসহ দেশবরেণ্য প্রায় সকল ওলামায়ে কেরামই বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ও সক্রিয় ছিলেন।
তখন ইরাক-ইরান ২টি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ যুদ্ধ চলছিল। এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ১৯৮২ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের পক্ষ থেকে হাফেজ্জী হুজুর রহ: ইরান সফরে যান । ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং সে দেশের শীর্ষনেতৃবৃন্দের সাথে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে মতবিনিময় করেন। ইরান থেকে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে হজ পালন করতে যান। সৌদি আরব সরকারও হযরতকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেন। হজ্জ শেষে ৭ অক্টোবর ১৯৮২ সালে হাফেজ্জী হুজুর ইরাক সফরে যান। ৯ অক্টোবর ইরাকের প্রেসিডেন্টের সাথে যুদ্ধ বন্ধে মতবিনিময় করেন, প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের অনেক প্রশ্নের জবাব দেন এবং ইরাকে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার আহবান জানান হাফেজ্জী হুজুর রহ:। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম যুদ্ধ বন্ধে হাফেজ্জী হুজুরের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের প্রস্তাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দুই দেশের যুদ্ধ বন্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সাদ্দাম হোসেন আন্তর্জতিক ষড়যন্ত্রকে ভেদ করে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হলেন।
১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়ত হাফেজ্জী হুজুর সকল পথ ও মতের দেশের সকল দলের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মানবতার মুক্তির গ্যারান্টি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী হুকুমত কায়েমের আন্দোলনে শরিক করার মহান লক্ষ্য নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাকশাল, কমিউনিস্ট পার্টি, সাম্যবাদী দল, মুসলিম লীগ, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ, পিপলস লীগ, রিপাবলিকান পার্টি, জামায়াত, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপিবিসহ ৩৪টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছিলেন। খেলাফত আন্দোলনের এ গোলটেবিল বৈঠক উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন আলোড়ন ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
গোলটেবিল বৈঠকে হাফেজ্জী হুজুর তিন দফা দাবি পেশ করেন।[ ১] অনতিবিলম্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা করা। [২] ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনা করা।[৩] দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করে তিন মাসের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। গোলটেবিল বৈঠকের ৩নং দাবিটিই পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখায় পরিণত হয়। হাফেজ্জী হুজুরের এ প্রস্তাবটি সকল দলের গণদাবিতে পরিনত হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮৩ সালে ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসম্মেলন। সম্মেলন শেষে এরশাদ সরকারের জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল মিছিল নিয়ে বায়তুল মোকাররমে একটি ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে হযরত হাফেজ্জী হুজুর ঘোষণা করেন বর্তমান সরকার না ইসলামী সরকার, না জাতীয় সরকার। এখন দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় জনগণ একটি ইসলামী সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর হযরত হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে দশটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ। একই বছর ২১ শে ডিসেম্বর রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সভাপতির ভাষণে হাফেজ্জী হুজুর বলেন, দুর্নীতির গণতন্ত্রের বদলে আমিরুল মুমিনীন, মজলিসে শুরার পদ্ধতি এবং কোরআন-সুন্নাহর শাসন প্রবর্তনের জন্যই আমার সংগ্রাম । সমাবেশে সর্বদলীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
১৯৮৫ সালের ২৫ জুলাই হাফেজ্জী হুজুর লন্ডনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। সম্মেলনে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে ইসলামী শাসনপ্রতিষ্ঠায় হাফেজ্জী হুজুর ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার হাফেজ্জী হুজুরের ঐ আহ্বান শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা ও থানাগুলোতে অনুষ্ঠিত খেলাফত আন্দোলনের সমাবেশ-মহাসমাবেশগুলোর মধ্যে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ছুটে আসত লাখ লাখ মানুষ। দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক গণবিপ্লবের সম্ভাবনা। তখন নজর পড়লো দেশি-বিদেশি ইসলাম-বিদ্বেষী মহলের। শুরু হলো ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্টার আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে হাফেজ্জী হুজুর রহ:-এর ছাত্র-মরিদ ও কাছের মানুষদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে ভিন্ন হওয়া। (এ প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর আল্লামা সিরাজুল ইসলাম রহ: আফসোস করে প্রায়ই বলতেন, "হাফেজ্জী হুজুরের ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার বিজয়ের নৌকাটি নদী পার করে ঘাটে ভিরার সময় হুজুরের ডানে-বামের লোকজন নৌকাটি ডুবিয়ে দিলো"।) আর বিশাল ঐক্য ভেঙ্গে সৃষ্টি করলো ইসলামের নামে খন্ড খন্ড দল। জামায়াতে ইসলামি ছাড়া এই সমস্ত খন্ড খন্ড দল একসময় হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলনের পতাকা কলে ছিলো। বিভক্ত না হয়ে খেলাফত আন্দোলনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলে আজ বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম থাকতো। এরপরেও হাফেজ্জী হুজুর হতাশ নাহয়ে তাঁর দেশব্যাপী সফর ও খেলাফত আন্দোলনের দা'ওয়াতী মিশনের কাজ অব্যাহত রাখলেন।
১৯৮৬ সালে পুণরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী হয়ে হাফেজ্জী হুজুর বটগাছ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচনে তিনি সরকারি হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
৮ রমজান ১৪০৭ হিজরী, ১৯৮৭ সালের ৭ মে হযরত আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর ইহজগত ত্যাগ করেন। অতপর ৮ মে ঐতিহাসিক জানাজার নামাজের পূর্বে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সভায় হাফেজ্জী হুজুরের বড় সাহেবজাদা মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফকে দলের ভারপ্রাপ্ত আমীর এবং ৩ জুলাই ১৯৮৭ ইং দলের মজলিসে শূরার অধিবেশনে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ‘আমীরে শরীয়ত’ নির্বাচিত হন। ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ইং তারিখ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সহিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর এর দায়িত্বে বহাল থাকেন তিনি।
মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ এর অসুস্থতা ও বার্ধক্যের কারণে ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ইংরেজী বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে হাফেজ্জী হুজুর রহ: এর সুযোগ্য ছোট সাহেবজাদা, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মাওলানা হাফেজ ক্বারী আতাউল্লাহ হাফেজ্জীকে দলের "আমীরে শরীয়ত" নির্বাচিত করা হয় এবং সাবেক আমীর মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ সাহেব নিজ হাতে নবনির্বাচিত আমীরে শরীয়ত আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দেন। বর্তমানে আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, ইসলাম ও দেশ বিরোধী যে কোন অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সর্বদা প্রথম প্রতিবাদী সংগঠন। মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা রক্ষায় ভন্ড নবীর দাবিদার কাদিয়ানীসহ সকল বাতিলের বিরুদ্ধে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় আছে এবং থাকবে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।