রহমত ডেস্ক 14 February, 2022 04:15 PM
জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে কথা বলা অমূলক। মানবাধিকার নেই, মানবিক মর্যাদা নেই, গণতন্ত্র না থাকলে এসব থাকে না। বিশ্বে সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে আসীন হতে হলে গণতন্ত্রের শর্তগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ভোটাধিকার ও মানবাধিকার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে এর উৎপত্তি। বর্তমান অবস্থায় উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আইন প্রণেতারা আইন প্রণয়নের চেয়ে উন্নয়নেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু উন্নয়ন কখনও গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থা নয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও এটাই সত্য। নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তৃণমূল পর্যায়ে এ নির্বাচন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচন বলা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আজ (১৪ ফেব্রুয়ারি) সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে শেষ কর্মদিবসে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
মাহবুব তালুকদার বলেন, বিদায়কালে আত্মবিশ্লেষণের তাগিদে আমি বলি, নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা যেসব অভিযোগ সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। লিখিতভাবে যেসব অভিযোগ পাঠানো হয়, তারও যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না দিয়ে নথিভুক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে বিগত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে গত পাঁচ বছরে যা কিছু বলেছি, তাতে কোনো ফলোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না, আগেও বলেছি নির্বাচন কমিশন গঠন আইন বাধ্যতামূলক। তবে আইনটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সংকটের সমাধান হবে না। এখন পর্যন্ত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে না। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি সব সংকটের সমাধান দেখতে চাই।
তিনি বলেন, নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অপরিহার্য। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অনুপস্থিত। এতে বিশেষভাবে টাকার খেলাই প্রতিভাত হয়। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন, আইন প্রণেতারা ভবিষ্যতে আইন ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন না তো? অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাবিঘ্নগুলো দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য সংবিধান ও বিধিবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত দূরত্ব কখনোই ছিল না। আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। কমিশনের কারও সঙ্গে কখনও কোনো ব্যক্তিগত দূরত্ব থাকবে না। আমি যে বিএনপির মুখপাত্র এটা আমিই প্রথম জানতে পারলাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে। মজার ব্যাপার হলো আমি যখনই দৃঢ়ভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করি গণতন্ত্রকে উদ্ধারের জন্য, তখনই কয়েকজন লোক বলে আমি নাকি বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে কথা বলি। খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব মন্তব্য করেছেন। আসলে বিএনপির যে কি সুর সেটা আমি জানি না। যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা হয়ত বা জানেন আমি তো জানি না।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে আমরা গণতন্ত্রকে যেভাবে দেখতে চাই সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমানে গণতন্ত্র সমুন্নত নয়। এজন্য আমি বলি গণতন্ত্রকে জনকল্যাণে ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমি নীরব জনগোষ্ঠীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি। যে কথাগুলো কেউ বোঝে না, কেউ লেখে না, কেউ জানে না আমি সেগুলোই বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি নির্বাচন কমিশনের পাঁচ জনের একজন, মানে পাঁচ আঙুলের এক আঙুল। কিন্তু আমি এখনও নিশ্চিত না যে আমি এ পাঁচ আঙুলের মধ্যে কোন আঙুল। একজনের পক্ষে কিছু করা যায় না। আমি গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে, গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে হেরে গেলাম। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, আমি কমিশনে বক্তব্য দিতে গিয়েছি কিন্তু তারা আমাকে বক্তব্য দিতে দেয়নি। তারা বলেছে আমি নাকি সংবিধানবিরোধী কথা বলেছি। আরে সংবিধানই তো আমাকে ক্ষমতা দিয়েছে।