| |
               

মূল পাতা রাজনীতি উচ্চকিত শ্লোগাণের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ‘শেখ গোলাম আসগর’


উচ্চকিত শ্লোগাণের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ‘শেখ গোলাম আসগর’


অধ্যাপক মোঃ আবদুল জলিল     14 February, 2022     03:17 PM    


ঢাকার রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের, উচ্চকিত শ্লোগাণের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিলেন জনপ্রিয় সংগঠক রাজপথের লড়াকু সৈনিক আলহাজ্জ শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ছিলেন খেলাফত মজলিসের যুগ্মমহাসচিব ও ঢাকা মহানগরী সভাপতি। ২০২০ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী হঠাৎ করেই বিদায় নিলেন তিনি। একজন যোগ্য সংগঠক, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ, সফল ব্যবসায়ী, কর্মপ্রিয় ও আশাবাদী মানুষ ছিলেন শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৯৬৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার লালবাগে তার জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছেন মতিঝিলের আরামবাগে। পিতা শেখ গোলাম মোস্তফা ও মাতা আসমা খাতুনের ৫ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে শেখ গোলাম আসগর ছিলেন ষষ্ঠ। শিক্ষা জীবনে মতিঝিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু। মতিঝিল মডেল স্কুলে মাধ্যমিক, বিএএফ শাহীন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে বিএসসি এবং পরে জগন্নাথ কলেজে পড়াশুনা করেন ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

শেখ গোলাম আসগর স্কুল জীবন থেকেইে ইসলামী সংগঠনের সাথে সংযুক্ত হোন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে শিশু সংগঠন ‘ফুলকুড়ি’র কাজের মাধ্যমে তার সাংগঠনিক কাযক্রম শুরু। তিনি আবাবীলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি একজন ভালো ফুটবলার ছিলেন। পরবর্তীতে আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনে খুবই সক্রীয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের ঢাকা মহানগরী সাধারণ সম্পাদক পরের বছর ঢাকা মহানগরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫-৯৬ সেশনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের সেক্রেটারী জেনারেল ও ১৯৯৬-৯৭ সেশনে কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন সমাপ্ত করে তিনি খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরীর সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এরপর দীর্ঘ সময় খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। পরে তিনি খেলাফত মজলিসের যুগ্মমহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০২০ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

শেখ গোলাম আসগর একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ঢাকার আরামবাগে গ্রান্ড ট্রেডার্স নামে কাগজসহ প্রিন্টিং সামগ্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী ছিলেন। তিনি ঢাকা পেপার এন্ড প্রিন্টিং ইন্ক মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ছিলেন এবং ২০২০ সালে পর্যন্ত তিনি ঐ ব্যবসায়ি সংগঠনের নির্বাচিত সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রো-একটিভ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ছিলেন, প্রো-একটিভ মেডিকেলের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। ব্যবসায়িক কারণে তিনি যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত সফর করেন। পবিত্র হজ¦ ও উমরার উদ্দেশ্যে একাধিকবার সৌদি আবর সফর করেন। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে আগ্রহী শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সাংষ্কৃতিক সংগঠন দাবানল শিল্পীগোষ্ঠী ও জাতীয় সাংস্কৃতিক ফোরাম-জাসাফ’র উপদেষ্টা ছিলেন। লেখা লেখিতে অত্যন্ত দক্ষ শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ইনতিফিাদা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এবং উইকলি টাইম এন্ড টাইড পত্রিকার সম্পাদক ও অনলাইন পোর্টাল আপডেট২৪ডটনেট’র উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন।

আন্দোলন সংগ্রামের ময়দানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন মরহুম শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। মাদরাসায় পড়াশুনা না করলেও দেশের আলেম-উলামাদের সাথে তার অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। ৩ ছেলের জনক শেখ গোলাম আসগরের বড় ছেলের নাম রাখেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুর হক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ছোট ছেলে ঢাকার উত্তরায় একটি মাদরাসায় হাফেজী পড়ছে। তিনি হযরত হাফিজ্জি হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলন, মুরতাদ সালমান রুশদী বিরোধী আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একজন সক্রীয় কর্মী ছিলেন। মুরতাদ তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে গড়ে উঠা আন্দোলন ও অযোধ্যা অভিমুখে লংমার্চ, ৪ দলীয় জোট ও ২০ দলীয় জোটের ফ্যাসিবাদী সরকার বিরোধী আন্দোলন ও সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামীর আন্দোলনের একজন সংগঠক ও একই সাথে রাজপথে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার রাজপথের বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘটিত আান্দোলন সংগ্রাম, মিটিং- মিছিলের সম্মুখ সারির নেতা ও শ্লোগানের বলিষ্ঠ কন্ঠ ছিলেন শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি । মতিঝিল, গুলিস্তন, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, প্রেসক্লাব এলাকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হতো তাঁর দরাজ গলার ‘নারায়ে তাকবির- আল্লাহু আকবর’ শ্লোগানে।

তিনি খেলাফত মজলিসের নেতা হলেও দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত মধুর। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে তাকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। আর দলীয় নেতা-কর্মীদের আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভরসার অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিলেন শেখ গোলাম আসগর রহ.। কর্মীবান্ধব নেতা বলতে যা বোঝায় শেখ গোলাম আসগর রহ. তাই ছিলেন। সংগঠনের নেতা-কর্মী, বন্ধু-বান্ধবদের বিপদে আপদে তিনি পাশে থাকতেন, সহযোগিতার চেষ্টা করতেন। যে যত বড় সমস্যা নিয়েই তার কাছে আসতেন তিনি তাকে আশ্বস্ত করেতন, সমাধানের পথ দেখাতে। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন। সবাইকে স্বপ্ন দেখাতেন সুন্দর ভবিষ্যতের। বাংলার সবুজ জমিনে ইসলামী আদর্শের আলোকে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের ভেলায় ভেসে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি ছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।

মৃত্যুর আগের দিন রাতেও তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠক শেষে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন বিছানায় যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। তার জীবনের সর্বশেষ কাজ ছিলো ঢাকা মহানগীর খেলাফত মজলিসের ২০১৯ সালের কাজের উপর একটি মন্তব্য লেখা যা তিনি মৃত্যুর দিন রাত বারোটার পরে কোন এক সময়ে লিখে রেখে গেছেন পরের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ সকালে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অধিবেশনে পেশ করার জন্য। নিজ স্বক্ষরের নিচে ‘১৪/২/২০২০’ লেখা সে মন্তব্য প্রতিবেদন আমাদের হাতে আসলেও তিনি আর তা পেশ করতে পারেন নি। আল্লাহর ডাকে সারা দিয়ে হঠাৎ করেই পারি জমালেন অনন্তের পথে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে স্ট্রোক করে অসুস্থ হওয়ার পরে সকালে তাকে রাজধানীর ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটালে (বারডেম হাসপাতাল) ও পরবর্তীতে গ্রীন লাইফ হাসপাতালে নেয়া হয়। গ্রীন লাইফ হাসপাতালের আইসিইউতে শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের সকলের প্রিয় নেতা শেখ গোলাম আসগর ররাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে মরহুমের লাশ সিদ্ধেশ্বরী থেকে আরামবাগ নেয়া হলে আরামবাগ ফকিরাপুল এলাকায় নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আরামবাগ ফকিরাপুল এলাকায় ব্যবসায়ীরা এ দিন তাদের মার্কেট বন্ধ রেখে শোক প্রকাশ করেন। আরামবাগ থেকে লাশ নিয়ে আসা হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। বাদ যোহর বায়তুল মোকাররম মসজিদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, আলেম-উলামা, মরহুমের বন্ধু-স্বজনসহ হাজারো মুসল্লির উপস্থিতিতে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন আমীরে মজলিস অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক। জানজা শেষে আজিমপুর গোরস্তানে পিতা-মাতার করে চির নিন্দ্রায় শায়িত করা হয় শেখ গোলাম আসগরকে রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

আলহাজ্জ শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির আকর্ষিক মৃত্যুর ঘটনায় সংগঠনের দেশ বিদেশের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, বন্ধু-বন্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই বিমর্ষ ও শোকাবিভূত হয়ে পরেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ইসলামী ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। খেলাফত মজলিসের সারা দেশের নেতা-কর্মীদের বুক ফাঁটা কান্না আর অশ্রু বিসর্জন যেন থামতেই চাচ্ছে না। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে শেখ গোলাম আসগর ভাই এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু যবনিকার ওপাড়ে চলে যাবেন তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। দুই বছর পর এখনো অনেক নেতা-কর্মী, বন্ধুজন শেখ গোলাম আসগর রহ. এর কথা স্মরণ করে নিরবে নির্ভৃতে অশ্রু বিসর্জন করেন। তাঁর মাগফিরাতের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন। যারা আসগর ভাইয়ের মাগফিরাতের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতেন বিগত দুই বছরে তাদের মধ্যে অনেকেই পারি জমিয়েছেন পরপারে। আমাদের অভিভাবক মাওলানা মুহাম্মদ শফিক উদ্দিন ভাই, মাওলানা সৈয়দ মজিববর রহমান পেশোয়ারী সাহেব, বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউল আলম, ডাঃ নজরুল ভাই, আইউব আলী ভাই, দেলওয়ার ভাই, হেলাল ভাই, সর্বশেষ আমাদের আবদুল মালেক ভাই-সহ অনেকেই পারি জমিয়েছেন অনন্তের পথে। আসগর ভাই-সহ সকলের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

আমরা সবাই মরহুম শেখ গোলাম আসগর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্য সব সময় দোয়া করবো আল্লাহ যেন তার জীবনের সমস্ত গুনাহখাতা মাফ করে দিয়ে দিয়ে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। তার স্ত্রী, পুত্র পরিজনকে সবরে জামিলের তাওফিক দান করেন। একই সাথে তার আমৃত্যু লালিত স্বপ্ন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন তথা খেলাফত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিতে সবাই সচেষ্ট হবো। এটাই আজকের প্রত্যাশা।

লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, খেলাফত মজলিস