| |
               

মূল পাতা ফিচার যেসব কারণে ধ্বংস হয়ে যাবে ইসরাইল : পর্ব-এক


যেসব কারণে ধ্বংস হয়ে যাবে ইসরাইল : পর্ব-এক


রহমতটোয়েন্টিফোর ডেস্ক     16 November, 2021     10:38 PM    


দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল এমন সময় এ অঞ্চলের অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ ও বিবাদে লিপ্ত এবং এমনকি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছে বলে দাবি করছে যখন তারা নিজেরাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তীব্র অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত।

ইহুদিবাদী ইসরাইল সবচেয়ে বেশি যে অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত তা হচ্ছে তীব্র জনসংখ্যা সংকট। জনসংখ্যা স্বল্পতা তাদের জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধভাবে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জনসংখ্যা তাদের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদেরকে ইসরাইলে এনে জড়ো করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইসরাইলি কর্মকর্তারা নিরাপত্তা বেষ্টিত উন্নত জীবন যাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসব ইহুদিদেরকে দখলিকৃত এলাকায় আসতে এবং সেখানে স্থায়ী আবাসন গড়তে উদ্বুদ্ধ করে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে ইসরাইলে। এ কারণে ইহুদি অভিবাসীরা সুযোগ বুঝে ইসরাইল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ইসরাইলের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০০৯ সাল থেকে বহু ইহুদি ইসরাইল ছেড়ে চলে গেছে। বহু ইহুদি অভিবাসীকে দেখা গেছে একবার ইসরাইল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তারা আর সহজে ফিরে আসছে না। যারা ফিরে এসেছে তাদের সংখ্যা না ফেরাদের তুলনায় খুবই কম।

ইসরাইলি জনসংখ্যার কাঠামোয় একটি বড় সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিরা এখানে আসায় তাদের মধ্যে জাতিভেদ খুবই প্রকট। এসব অভিবাসী ইহুদিদের মধ্যে ১০০টিরও বেশি গোত্র বা জাতীয়তা রয়েছে। তাই যেখানে ১০০টির বেশি গোত্রের ইহুদিদের বসবাস সেখানে তীব্র সামাজিক সংকট, বৈষম্য এমনকি সংঘাতের আশঙ্কাও প্রবল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে  বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিটি গোত্রের ইহুদিদের মধ্যে নিজস্ব পরিচিতি ও কৃষ্টি ধরে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর এটাই অভিন্ন ইসরাইলি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা এবং এ কারণে সামাজিক সংকট ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। যে গোত্রের শক্তি ও প্রভাব যত বেশি তারা ইসরাইলি মন্ত্রিসভায় ততবেশি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রেখে এমনকি সংবিধান লঙ্ঘন করে হলেও যারা যেভাবে পারে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করায় অন্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়।

ইসরাইলে সামাজিক সংকটের আরেকটি দিক হচ্ছে ক্রমবর্ধমান গোত্রীয় সংঘাত। যার ফলে সামাজিক বিভেদ চরম আকার ধারণ করেছে। একদল ইহুদির অন্যদল ইহুদির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ইসরাইলি সমাজে ঐতিহ্যগত বিভেদ, আরব ও ইহুদিদের মধ্যে জাতিগত বিরোধ এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে মতভিন্নতা এই তিন বড় ধরনের সামাজিক সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে আরব ও ইহুদিদের মধ্যকার জাতিগত বিভেদ চরম আকার ধারণ করেছে। ঐতিহাসিক বিরোধ ছাড়াও আরব-অনারব বৈষম্য ইসরাইলে সামাজিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসরাইলে সামাজিক বিভেদের প্রভাব রাজনৈতিক অঙ্গনেও পড়েছে। সম্প্রতি আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষের পর গত মে মাসে মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ইসরাইল এমন সময় ফের গাজায় হামলা চালিয়েছে যখন তারা নিজেরাই তীব্র অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত। ইসরাইলে এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে, আরব ও ইহুদীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত যা গত কয়েক দশকে নজিরবিহীন ঘটনা।

ইসরাইলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইলান গ্রেল সাইমার ফরাসি দৈনিক লা মণ্ডে এক নিবন্ধে লিখেছেন, 'ইসরাইলের রাজপথে ইহুদি ও আরব নাগরিকরা একে অপরের ওপর হামলা চালাচ্ছে, দোকানপাটে লুটপাট চালাচ্ছে, উপাসনালয়গুলোতে অগ্নি সংযোগ করছে। এমনকি ঘরের পাশে প্রতিবেশিদের দেখলেও আতঙ্ক বিরাজ করছে সবার মধ্যে। ইসরাইলের বেশিরভাগ শহরে জাতিগত সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আর কোনো পরিবেশ ইসরাইলে নেই।'

খোদ ইহুদি সমাজের মধ্যেই বর্ণবাদী ও ধর্মীয় বিভেদ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চারটি কারণে সেখানে বর্ণ বা জাতিগত বিভেদ তৈরি হয়েছে। সেফারদিম ইহুদি জাতি, এশকানাজি ইহুদি জাতি, রুশ ইহুদি জাতি ও ইথিওপিয়ান ইহুদি জাতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিদের আগমনের কারণেই ইসরাইলে জাতিগত বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কেননা বিভিন্ন জায়গা থেকে আগমনের কারণে ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক থেকে এসব ইহুদিরা আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

সবচেয়ে বেশি বিভেদ রয়েছে এশকানাজি ও সেফারদিম গোত্রের ইহুদিদের মধ্যে। হিব্রু ভাষায় এশকানাজি গোত্রের ইহুদিরা মূলত জার্মানি। ১৭শ' ও ১৮শ' শতকে যেসব ইহুদিরা দক্ষিণ ইতালি থেকে জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিল তারা এশকানাজি গোত্র হিসেবে পরিচিত। হিব্রু ভাষায় সেফারদিম গোত্রের ইহুদিরা মূলত স্পেনিশ।

এ ছাড়া আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে আসা ইহুদি অভিবাসীদেরকেও সেফারদিম গোত্র হিসেবে ধরা হয়। এই দুই ইহুদি গোত্রের  মধ্যে নামাজসহ অন্যান্য ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, ব্যক্তিত্ব, আচরণ, পোশাক আশাক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

তবে ইসরাইলি সমাজের নাগরিকদের মধ্যে বিভেদের আরেকটি দিক হচ্ছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইহুদিদেরকে আলাদাভাবে দেখা হয়। প্রাচ্যের চেয়ে পাশ্চাত্যের ইহুদিদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয় এবং প্রাচ্যের ইহুদিদেরকে নীচুভাবে দেখা হয়। এই বিভেদ এখন চূড়ান্ত ও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ফলে সেখানে অর্থনৈতিক সুবিধা ও আবাসনসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ইসরাইলে সেক্যুলার ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও তীব্র মতবিরোধ চলে আসছে। ইসরাইলি সমাজে তিন ধরনের ইহুদি রয়েছে। এক শ্রেণির ইহুদিরা সমগ্র জীবনে কঠিনভাবে শরীয়া আইন মেনে চলার পক্ষপাতী। দ্বিতীয় শ্রেণির ইহুদিরা ঐতিহ্য অনুসারে সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী চলতে আগ্রহী। তারা কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, ঐতিহ্যবাহী বিয়ের রীতি, হালাল খাদ্য গ্রহণ প্রভৃতি মেনে চলে। আর তৃতীয় শ্রেণির ইহুদিরা হচ্ছে সেক্যুলার মানসিকতার এবং ধর্মের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তবে ইহুদিবাদের নীতিতে তারা বিশ্বাসী।

৭৬ বছর ধরে দখলদারিত্ব বজায় রাখলেও আজও জাতি হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় এটা ইসরাইলের জন্য আরকটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোটকথা এভাবে ইসরাইলি সমাজে নানাবিধ সংকট দিন দিন প্রবল হচ্ছে। (পার্স টুডের সৌজন্যে)

/জেআর/