| |
               

মূল পাতা আরো বিশ্ব প্রবীণ দিবস : তবুও ভালো থাকুক সন্তানেরা


বিশ্ব প্রবীণ দিবস : তবুও ভালো থাকুক সন্তানেরা


বিশেষ প্রতিবেদক     30 September, 2021     06:29 PM    


বাবা ছিলেন বিশাল ধন সম্পদের মালিক, বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জে। সোনার চামচ মুখে নিয়েই পৃথিবীতে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে প্রথম আলোর মুখ দেখেছিলেন শ্রীদেবী (ছদ্দনাম)। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে এক বোন ছিল সোনায় সোহাগা। বয়স যখন ৯ বছর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে তাদের বাড়িতে। একে একে মেরে ফেলে চার ভাই, তার বাবা ও মাকে। এক ভাই চলে যান যুদ্ধে। স্বজনহীন হয়ে পড়েন সে।

দু’চোখে তখন আবছা অন্ধকার। ছোট শিশু কোথায় যাবেন কী করবেন? তার অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে  হাফিজ উদ্দিন নামের এক কুরআনের হাফেজ তাকে নিয়ে যান বাড়িতে। থেমে যায় মুক্তিযুদ্ধ, মুসলমানের বাড়িতে পালিত হওয়ায় পরে যুদ্ধ ফেরত ভাই তাকে মেনে নেননি। এক সময় ভাইও নিখোঁজ হয়ে যান। আর চাচারা সম্পত্তির লোভে  হিন্দু পরিবারে ফিরিয়ে নেননি তাকে।

মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে হাফিজউদ্দিনের সন্তান পরিচয়ে পরিচয়ে তার বাড়িতেই সে বড় হয়ে ওঠেন তিনি। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হাফিজউদ্দিন তাকে লেখাপড়া করাতে ঢাকায় একটি মাদরাসায় এনে ভর্তি করান। হাফিজউদ্দিনের প্রচেষ্টায় সে ১৯৮১ সালে ঢাকা থেকে দাখিল পাশ করেন। একই সময়ে নিজেকে কুরআনের হাফেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সে বছরেই বদিউল আলম নামের এক মসজিদের ইমামের সঙ্গে বিয়ে হয়। একে একে জন্ম হয় তার দুই মেয়ের। পরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। মৃত্যুর সময় স্বামী তার হাত ধরে তাকে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে যান। স্বামীর কথামতো তিনি লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে দীর্ঘদিন উচ্চপদে সরকারি চাকরি করে অবসরে যান গত বছর।

বৃদ্ধশ্রমে আসার গল্প : মাত্র নয় বছর বয়স থেকে সংগ্রাম করে আসা এই ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী নিজের উপার্জিত অর্থে দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন। মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বহুতল বিশিষ্ট বাড়িও করেছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে। সন্তানদের করেছেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত, বিয়েও দিয়েছেন। আলাদা আলাদা বাড়িতে মেয়েরা সুখেই ছিল। বেশ কয়েকবছর পূর্বে হঠাৎ করে তার ছোট মেয়ের স্বামী মারা যান। পরে মেয়ে ও নাতনীদের তিনি তার বাসায় নিয়ে আসেন। নাতি নাতনীদের নিয়েই ভালই কাটছিল অবসরের দিনগুলো। তাদের সঙ্গেই শেষ দিন পর্যন্ত কাটানোর ইচ্ছা ছিল। অথচ অর্থের জন্য তার মেয়েরা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে থাকে। নিজের সঞ্চয়ের ৫৫লাখ টাকা ছিল ব্যাংকে গচ্ছিত। লোভ জাগে তার বড় মেয়ের। তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে এটিএম কার্ড ও পিন নাম্বার নিয়ে কয়েক দফায় পুরো টাকায় উঠিয়ে নেন তার বড় মেয়ে।

এতে ছোট মেয়ে প্রতিনিয়তই টাকার জন্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে। মেয়ের এমন আচড়ে দাগ কেটে যার তার মনে। তার প্রতিটি কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়ান তার ছোট মেয়ে। একদিন খাবারের সময় হলে ধাক্কা দিয়ে তার সামনে খাবারের প্লেট দেন মেয়ে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তিনি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে যায় তার।
আত্নহত্যারও সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু এ ঘরে যে বাস করে তার মেয়ে নাতি নাতনী। তারা ভয় পাবে। তাই গত মার্চ মাসের এক রাতে বাসার মূল ফটকের চাবী নিয়ে নেন নিজের কাছে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে সবার অগোচরে বেড়িয়ে আসেন বাসা থেকে। দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে ছুড়ে আসেন মূল ফটকের চাবী। বন্ধ করে দেন ব্যবহৃত মুঠোফোন। চলে আসেন গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে। যেখানে শত আশ্রিতের সঙ্গে স্বজনহীন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা তিনি।

সংগ্রামী এ নারী জানান, তার জীবনলিপি হয়তো সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন ভাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন। বাঁকে বাঁকে মোড় নিয়েছে অতিবাহিত হওয়া সময়গুলো। কত কষ্ট করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সন্তানদের মানুষ করেছেন। অথচ জীবনের শেষ সময়ে তাদের দুর্ব্যবহার মেনে নিতে পারি না। অর্থের জন্য নিজের মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ কি ভোলা যায়? তাই তাদের সুখের কথা বিবেচনা করেই তাদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি। অন্তত তারা যেন ভালো থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত এমন আশীর্বাদ থাকবে তাদের জন্য। এখনো পেনশনের কোটি টাকা থাকলেও আর ফিরে যাবেন না  স্বজনদের কাছে। এখানেই সবার সুখ দুখের ভাগীদার হয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে চান।

গাজীপুরের মনিপুর এলাকায় দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী গিভেন্সী গ্রুপের কর্ণধার খতিব মুকুল ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। যেখানে ভাগ্য বিড়ম্বিত নারী ও পুরুষের ঠাঁই হয়েছে। বর্তমানে এখানে ৮০ জন পুরুষ ও ৭০ জন নারী রয়েছেন। যাদের অনেকেরই সন্তান দেশের বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব মুকুল বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের অনেকেই সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি। যে পিতা মাতার অপরিসীম ত্যাগ তীতিক্ষার ফলে সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত সে সন্তান অনেক সময় তার বৃদ্ধ পিতা মাতাকে অবজ্ঞা করছে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। এমন অনেক বাবা ও মা যেমন এখানে আছেন। তেমনি অনেক অসহায় বাবা ও মা শেষ জীবনে এখানে কাটাচ্ছেন। তাদের সবার জীবনের গল্পটা কষ্টের। আমরা আশাবাদী মানুষ নতুন প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা থাকবে কোনো বাবা ও মায়ের স্থান যেন বৃদ্ধাশ্রমে না হয়।

/জেআর/