| |
               

মূল পাতা আরো সম্পাদকীয় জিন্নাহ থেকে হাসিনা : ক্ষমতার মসনদ ক্ষণস্থায়ী


জিন্নাহ থেকে হাসিনা : ক্ষমতার মসনদ ক্ষণস্থায়ী


রহমত নিউজ     19 October, 2024     12:40 PM    


দুনিয়ার কোনোকিছুই স্থায়ী নয়। আশা আর ভালোবাসা দিয়ে তৈরি স্বপ্নের ইমারত ছেড়ে সবাইকেই চলে যেতে হয়। এ এক অনিবার্য জীবনচক্র।

মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ এগিয়ে আসলেন ভারতীয় মুসলিমদের জন্য পৃথক একটা রাষ্ট্র গঠন করতে। প্রতিষ্ঠা হলো মুসলমানদের পাকিস্তান। সেই সূত্র ধরেই পাকিস্তানীদের অন্তরের মণিকোঠায় স্থান পেলেন জিন্নাহ। ভূষিত হলেন "কায়েদে আজম" উপাধিতে। তবে যিনি একখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেন, সেই প্রতিষ্ঠাতা দুনিয়া ত্যাগ করেছেন নিজ দেশের মানুষেরই একগাদা অবহেলা বুকে নিয়ে। 

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে ডাক্তার তাকে এই ব্যাপারে অবগত করেনি। জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরলেন কায়েদে আজম। সেসময় তার শরীরের ওজন মাত্র ৪০ কেজি। ফুসফুসে ক্যান্সার নিয়ে করাচির মৌরিপুর বিমানবন্দরে ল্যান্ড করলেন। শুধুমাত্র তার সামরিক সচিব অপেক্ষা করছিলেন সেখানে। যেই পাকিস্তান তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন, সেই দেশের আর কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

কায়েদে আজমের দেহটা বহন করার জন্য একটা এম্বুলেন্সের সন্ধান করতে থাকলেন  সামরিক সচিব। ব্যাপক চেষ্টার পর এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হলো। জিন্নাহ রওনা হলেন গভর্নর হাউজের দিকে। সাথে ছিলেন বিদেশ থেকে আসা এক নার্স ও তার বোন ফাতিমা জিন্নাহ। হঠাৎ রাস্তার মধ্যে পেট্রল শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো এম্বুলেন্স। 

জিন্নাহ'র সাথে থাকা ফাতেমা জিন্নাহ তার "মাই ব্রাদার" বইতে লিখেছেন, এম্বুলেন্স নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আমাদের এক ঘণ্টা সেখানে অপেক্ষা করতে হয় অন্য একটি এম্বুলেন্সের জন্য। কতটা নির্মম; যিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তাকে বহন করছে নড়বড়ে এক এম্বুলেন্স। সেটিরও আবার পেট্রল শেষ হলো পথিমধ্যে।  

কায়েদে আজমের শরীরের উপর পাকিস্তানের মাছিরা ভনভন করছিল। একটা পেপার দিয়ে বাতাস করে সেগুলো বিতাড়িত করছিলেন ফাতিমা জিন্নাহ। সেই রাস্তার পাশেই ছিল শতশত রিফিউজিদের কাগজের ঝুপড়ী। সেই উদ্বাস্তুরা জানতেও পারেনি অসহায় অবস্থায় তাদের ঝুপড়ির পাশেই পড়ে আছেন পাকিস্তানের জন্মদাতা।

একঘণ্টা পর এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হলো। বোনকে সাথে নিয়ে পৌঁছালেন গভর্নর হাউজে। পরবর্তীতে তার জন্ম দেওয়া পাকিস্তান কেমন, সেটি আর দেখতে পারেননি তিনি। পাকিস্তানের বাতাসেই মিশিয়ে দিলেন তার শেষ নিঃশ্বাস। অন্তর ভর্তি অভিমান আর এক তাল অবজ্ঞা নিয়ে সেই রাতেই দুনিয়া ত্যাগ করলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

পাকিস্তানে তিনি রেখে গেলেন ভাষা আন্দোলনের বীজ। সেই আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়েই ৭১ সালে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতী তাদের মুক্তির পথ খুঁজে নেয়। সংঘটিত হয় একাত্তরে 'মুক্তিযুদ্ধ'। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। সেই দেশের মহানায়ক টুঙ্গি পাড়ার মিঁয়া ভাই শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু ছিল আরও ভয়াবহ। তাকে বলা হয় বাংলাদেশের 'জন্মদাতা'। কিন্তু সেই দেশেরই কিছু মানুষ তাকে হত্যা করল। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন তারই মন্ত্রীপরিষদের একজন মন্ত্রী। ঘনিষ্ঠও বটে। তিনি খন্দকার মুসতাক আহমেদ। সেই অর্থে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র তুলনায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু আরও বেশি হৃদয় বিধারক।

বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে ইদানীং প্রশ্ন ওঠে। এগুলো অবশ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল কিনা সেটাও ভেবে দেখা উচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বার বাড়িতে যখন হামলা করা হয়, তখন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মোহিতুল ইসলাম। 

লাইন পাওয়া গেল না কন্ট্রোল রুমের। ফোন দিলেন গণভবনের এক্সচেঞ্জ লাইনে। সেখানেও কাজ হলো না। মোহিতুল রিসিভার ধরে চিৎকার করে হ্যালো হ্যালো বলতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু এসে হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন, হ্যালো! আমি প্রেসিডেন্ট বলছি! ততক্ষণে মুহুর্মুহু গুলি শুরু হয়েছে দক্ষিণের জানালা দিয়ে। সে এক ভয়াবহ ভোর। গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হলো বঙ্গবন্ধুর দেহ।

শেখ কামাল গুলি খেয়ে যখন মোহিতুল ইসলামের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে। তখন তিনি বলেছিলেন, ভাই! ওদের বলুন আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। ওরা কিছুই শুনেনি। শুনতে চায়নি। নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় শেখ কামালকে। শেখ রাসেলও করুণ কণ্ঠে বাঁচার জন্য আবেদন করেছিলেন। ওরা সেটাও শুনেনি।  শেখ রাসেল মোহিতুল ইসলামের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ওরা আমায় মারবে না তো? মোহিতুল বললেন, না! তুমি ছোট মানুষ, ওরা তোমায় মারবে না। 

ছোট্ট রাসেল শেষ বারের মতো বেঁচে থাকার আকুতি জানিয়ে বলেছিল, "আল্লাহ'র দোহাই আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানীতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানীতে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন।" কেউ শুনেনি তার কথা। ছোট্ট রাসেলকেও মেরে ফেলা হলো। স্বাধিনতার 'স্থপতি' স্ব-পরিবারে শহীদ হলেন। বেঁচে রইলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। 

তারপর এই লাল-সবুজ পাতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বা নিয়েছিলেন পর্যায়ক্রমে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ। 

জিয়াউর রহমান তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। রাত্রিযাপন করছিলেন স্থানীয় সার্কিট হাউসে। তারপর ভোরের আলো চারপাশে ছড়িয়ে পরার আগেই তাকে হত্যা করা হয়। তিনি এই দেশের সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখতেন। 

জিয়াউর রহমান ঘটনার আগের দিন তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে। চট্টগ্রামে দুটি উপদলে বিভক্ত বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ২৯ মে রাতে স্থানীয় সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে ছিলেন জিয়াউর রহমান। ভোররাতে সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীতে তাকে বলা হতো “বাংলার বাঘ”। সেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতেই প্রাণ গেল জিয়াউর রহমানের।

“দুই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড, ১৯৮১-র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান” এই শিরোনামে একটি বই লিখেছেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, ‘ভোর চারটার দিকে সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি গুলি করতে করতে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে। সে (সহকারী প্রটোকল অফিসার) জানে না পুলিশ বা প্রেসিডেন্টের গার্ড তাদের বাধা দিতে পেরেছিল কি না। তবে তারা গুলি করতে করতে সার্কিট হাউসে ঢুকে যায়। মোশতাক লাউঞ্জে বসে ছিল। সেনারা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সে পাশের ডাইনিং রুমের টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ে। এরপর সে শুনতে পায় ভারী বুটের আওয়াজ। কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে প্রেসিডেন্টের রুমের দিকে যায়। এরপর সে আরও গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। কয়েক মিনিট পর ওপরের লোকগুলো নিচে চলে আসে আর তার কিছুক্ষণ পর শোনে গাড়ির আওয়াজ। সে বুঝল, যারা এসেছিল, তারা চলে গেছে। সে এত ভয় পেয়েছিল যে গাড়িগুলো চলে যাওয়ার পর সে পালিয়ে এসে গ্যারেজ থেকে আমাকে ফোন করেছে।  আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেসিডেন্ট কী অবস্থায় আছেন, সে জানে কি না, উত্তরে সে জানাল, এ ব্যাপারে এখনো কিছুই জানে না সে।’

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, উপজেলা পদ্ধতি চালু, হাইকোর্টের বেঞ্চ বিকেন্দ্রীকরণ, ঔষধ নীতি প্রণয়নসহ বেশকিছু কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন পল্লিবন্ধু হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ। দীর্ঘ ৭ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। সেই এরশাদেরও ক্ষমতার পতন হয়েছে ‘স্বৈরশাসক’ তকমা কপালে নিয়ে। 

২১শে বইমেলায় ছন্নছাড়া হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন এক একসময়ের দাপুটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। কেউ তার কাছে ভীড় করছে না। অটোগ্রাফ চাইছে না। বয়োবৃদ্ধ মানুষটা যেন একেবারেই মূল্যহীন। এমন চিত্র তো দেশের সবাই দেখেছে। এক সময়ের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য এনামুল হক উরফে জজ মিয়া। ক্ষমতার অলিগলি তার চেনা ছিল। ৩য় ও ৪র্থ সংসদ নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন এরশাদের পালক মেয়েকে। অথচ সেই জজমিয়া মৃত্যুবরণ করলেন সরকারের দেওয়া আবাসন প্রকল্পের ছোট্ট ঘরে। 

তাই তো জাতীয় কবি বলেছেন, “সকালবেলার ধনীরে তুই, ফকির সন্ধ্যাবেলা”। 

পৃথিবীর সকল স্বৈরশাসকের তালিকা প্রকাশ করা হলে সেখানে নিঃসন্দেহে স্থান পাবে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা। গুম-খুন আর হত্যাযজ্ঞে সমগ্র দেশটাকে অতিষ্ট করে তুলেছিলেন তিনি। ভুলে গিয়েছিলেন ক্ষমতার মসনদ ক্ষণস্থায়ী। তিনি একবারের জন্যও স্মরণ করতে চাননি সর্বশক্তিমান আল্লাহর সেই অসীম ক্ষমতাকে। 

গতক ১৫ বছর যারা বাংলাদেশের হর্তাকর্তা ছিল, এখন তারা পলাতক। আন্তর্জাতিক ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় নাম ছিল সালমান এফ রহমানের। অথচ ক্ষমতা হারানোর পর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসু হককে সাথে নিয়ে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে দাঁড়ি কেট ছদ্মবেশে তিনি পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। সদরঘাটে ধরা পড়ে গেলেন। 

তাই তো ব্রাজিলিয়ান সাহিত্যিক পাওলো কুয়েলহোর মতো বলতে ইচ্ছে করে,  এ জীবন ঝরে পড়া মড়মড়ে শুকনো পাতার মতো নিষ্প্রাণ। এখানে কেউ তার সজিবতা নিয়ে স্থায়ী হতে পারে না।

দুনিয়ায় যারা ভালো কিংবা মন্দ অবদান রেখে যান, তাদের স্থান হয় ইতিহাসের পাতায়। এই পাতায় যেমন নবাব সিরাজুদ্দৌলার স্থান হয়, তেমনি স্থান হয় বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর কিংবা মীর সাদেকদের।

লেখক : সাংবাদিক