| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক চীনের পাল্টা এশিয়া-ইউরোপের নতুন করিডরের অর্থায়ন করবে কারা?


চীনের পাল্টা এশিয়া-ইউরোপের নতুন করিডরের অর্থায়ন করবে কারা?


রহমত নিউজ ডেস্ক     14 September, 2023     12:15 PM    


দিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকেই ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি মেগা অর্থনৈতিক করিডরের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, যা বিশ্বের ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির দুনিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিভাবে এই করিডরের অংশ নয়, তার পরেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই প্রকল্পটি ঘোষণার সময় এটিকে ‘আ বিগ ডিল’ (একটা বিশাল ব্যাপার) বলে বর্ণনা করেছেন।পরে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকেও প্রকল্পটির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এই করিডর পুরো বিশ্বের কানেক্টিভিটি ও ‘টেঁকসই উন্নয়নে’র ক্ষেত্রে একটি নতুন দিশা দেখাবে।

দিল্লিতে এই প্রকল্পটির রূপরেখা ঘোষণার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছাড়াও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিসহ আরো বহু বিশ্বনেতা উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সবাই প্রায় একবাক্যে বলেছেন, চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভের একটি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই এই করিডরটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, আর সে কারণেই আমেরিকা এটি নিয়ে এতটা উৎসাহ দেখাচ্ছে।

‘ইন্ডিয়া – মিডল ইস্ট – ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’ বা আইএমইসি নামে পরিচিত এই করিডরটি ভারতের পশ্চিম উপকূল (আরব সাগর) থেকে শুরু হয়ে প্রথমে সমুদ্রপথে আমিরাতের উপকূলে গিয়ে ভিড়বে। দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দর থেকে করিডরটি এরপর রেলপথে আমিরাত, সৌদি আরব, জর্ডন হয়ে ইসরায়েলের হাইফা বন্দর পর্যন্ত যাবে। তৃতীয় বা শেষ ধাপে এই করিডরটি হাইফা থেকে ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে গ্রীস, ইতালি বা ফ্রান্সের বন্দরগুলোতে গিয়ে ভিড়বে – অর্থাৎ পুরো করিডরটি দক্ষিণ এশিয়া থেকে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত একটি নতুন বাণিজ্যিক রুট খুলে দেবে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই করিডরে সৌদি আরব থেকে (জর্ডন হয়ে) ইসরায়েলের মধ্যে রেল সংযোগের কথাও বলা হয়েছে, যদিও দুটি দেশের মধ্যে এখনও পর্যন্ত কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অথচ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পকে ‘যুগান্তকারী’ বলে ঘোষণা করেছেন। আর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এমবিএস তো নিজেই করিডরটির ঘোষণার সময় দিল্লিতে উপস্থিত ছিলেন। ফলে ‘আইএমইসি’ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার আগে পর্দার আড়ালে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই করিডরটির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কে বা কারা অর্থায়ন করবে, সেই বিষয়ে এখনও খুব একটা স্পষ্টতা নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

কূটনৈতিক জটিলতা বা অর্থনৈতিক বাধাগুলো কীভাবে দূর করা হবে তা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার না-হলেও এই অর্থনৈতিক করিডরটির ভাবনা, এবং স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণেই ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এটি এতটা আলোড়ন ফেলতে পেরেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

করিডরে কারা টাকা ঢালবে?
আইএমইসি-কে মূলত একটি ‘রেল ও শিপিং করিডর’ হিসেবে দেখা হলেও এই রুট বরাবর ইলেকট্রিসিটি কেবল, একটি হাইড্রোজেন পাইপলাইন ও হাই-স্পিড ডেটা কেবলও বসানো হবে। অন্তত এই করিডর নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের প্রস্তুত করা একটি ডকুমেন্ট সেরকমই জানাচ্ছে।পুরো করিডরটি জুড়ে ব্যাপক অবকাঠামো নির্মাণের কথা জানানো হলেও কোন দেশ, জোট কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পে অর্থলগ্নি করবে কি না, সেটা এখনও কিছু স্পষ্ট করা হয়নি।

দিল্লিতে অর্থনীতিবিদ ও কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ প্রবীর দে অবশ্য মনে করেন, যেহেতু এই করিডরে অনেকটা অংশে ‘এক্সিসটিং অ্যাসেট’ বা বিদ্যমান স্থাপনাকেই ব্যবহার করা হবে তাই একেবারে নতুন আকারে তৈরি করা বাণিজ্যিক করিডরের চেয়ে এটাতে তুলনামূলকভাবে কম খরচ হবে। তিনি আরো বলেন, যেমন ধরুন ভারতে যদি মুম্বাই বা গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরকে ব্যবহার করা হয় – এবং দুবাইতে জেবেল আলি বন্দরকে এই করিডরে কাজে লাগানো হয় তাহলে সেখানে কিন্তু বড় বড় শিপিংলাইন ভিড়বার মতো অবকাঠামো আগে থেকেই আছে।

করিডরের যে অংশটা প্রায় নতুন করে করতে হবে সেটা হল আমিরাত-সৌদি-জর্ডান-ইজরায়েলের মধ্যে রেল সংযোগের কাজ। হাইফা বন্দর থেকে ইউরোপ পর্যন্ত অংশটা আবার সমুদ্রপথে (ভূমধ্যসাগর) যাবে, সেখানেও বেশির ভাগ অবকাঠামো আগে থেকেই তৈরি আছে। মধ্যপ্রাচ্যের অংশে রেল সংযোগের কাজগুলোর বরাত বিভিন্ন ভারতীয় কোম্পানি পেতে পারে, এই ধারণার ভিত্তিতে ভারতে রেল নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার সোমবার থেকেই চড়চড় করে বাড়তে শুরু করেছে।

ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের ফেলো তারা কার্থা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত বছর ‘আইটুইউটু’ (ভারত, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আমিরাতের ব্লক) জোটের যৌথ বিবৃতিতেও এই ধরনের করিডরের একটি আভাস ছিল – আর সেখানে বেসরকারি লগ্নি টানার কথাও বলা হয়েছিল।

প্রবীর দে-ও বলছিলেন, “ভারতের মুন্দ্রা পোর্টটি আদানি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন। তারা যে এই করিডর নিয়ে উৎসাহ দেখাবে তা বলাই বাহুল্য।”

এই করিডরে প্রথমে ইসরায়েলের তেল আভিভ বন্দরের কথা বলা হলেও পরে হাইফা বন্দরকে মানচিত্রে দেখানো হয়েছে, যেখানে আদানির বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ ও ভাল নিয়ন্ত্রণ আছে। ফলে পুরো করিডরটির রূপরেখা তৈরিতে অনেকেই আদানি গোষ্ঠীরও ‘ফুটপ্রিন্ট’ দেখতে পাচ্ছেন। এছাড়া এই রেল-শিপিং করিডর বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সাতটি দেশের জোট জি-সেভেনের ‘পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্টের’ও (পিজিআইআই) অংশ – ফলে সামগ্রিকভাবে এর পেছনে জি-সেভেনের সমর্থন থাকবে বলেও ধরে নেয়া হচ্ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের পাল্টা জবাব হিসেবেই জি-সেভেন পিজিআইআই তৈরি করেছিল বলে মনে করা হয়।

কীভাবে সৌদি ও ইসরায়েল হাত মেলাবে?
এই অর্থনৈতিক করিডরের ‘জিগস পাজলে’ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা ছিল সৌদি আরব আর ইসরায়েলকে একই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে সম্প্রতি কিছুটা উষ্ণতার আভাস দেখা গেলেও এখনও রিয়াদ ও তেল আভিভের মধ্যে কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, ফলে একটা আন্তর্জাতিক প্রকল্পে দুই দেশ এক সঙ্গে কাজ করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিলই। তবে এমবিএস ও নেতানিয়াহু, দুজনেই এরই মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই করিডর নির্মাণের ব্যাপারে তাদের দুই দেশই খুবই আগ্রহী। আমেরিকায় বাইডেন প্রশাসন অবশ্যই এতে মধ্যস্থতার কাজ করেছে, পাশাপাশি ভারতকেও এখানে কাজে লাগানো হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন।

দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ শুভ্রকমল দত্ত বলছিলেন, সারা দুনিয়ায় হাতেগোনা যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে সৌদি আরব ও ইসরায়েল – উভয়েরই দারুণ সম্পর্ক, ভারত হল তার একটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এমবিএস ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু – দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কও অসাধারণ। ফলে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন, দুজনের সঙ্গেই কথা বলেছেন।

ভারতের জন্য এই প্রকল্পর গুরুত্ব বিরাট – কারণ এর মাধ্যমে তাদের জন্য ইউরোপের একটি নতুন প্রবেশপথ খুলে যাবে, কেবলমাত্র সুয়েজ ক্যানালের ভরসায় থাকতে হবে না। তা ছাড়া আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব রুখবার জন্যও ভারত ও আমেরিকা এই প্রকল্পটিকে কাজে লাগাতে চাইছে। তবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে সৌদি আরব এবং ইরান আগে থেকেই সংযুক্ত।

শুভ্রকমল দত্ত বলছিলেন, “লক্ষ্য করতে হবে এই প্রথম কোনও সৌদি নেতা ভারতে এলেন, যখন তিনি একই যাত্রায় পাকিস্তানে গেলেন না। ফলে এমবিএসের এই ভারত সফর পাকিস্তানের জন্য তো বটেই – এবং সেই সঙ্গে চীনের জন্যও – একটা বড় ধাক্কা।”

পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে চীনের অর্থায়নে যে ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ (সিপিইসি) নির্মিত হচ্ছে, তা তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোডের একটা মূল অংশ – যার মধ্যে দিয়ে চীন মধ্যপ্রাচ্যে ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করছে। আইএমইসি যে সেটারই জবাব দেওয়ার চেষ্টা – এবং আরও অনেক বৃহৎ পরিসরে – তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই।

তারা কার্থাও বলছিলেন, সৌদি আরব ও ইরানকে এ বছর একই টেবিলে বসিয়ে ও করমর্দন করিয়ে চীন শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চমকটা দিয়েছে। এখন সৌদি ও ইসরায়েলকে একই প্রকল্পের ছাতার তলায় এনে আমেরিকা, ইউরোপ ও তাদের সহযোগী ভারত আরো বড় চমক দিতে চাইছে বলেই তাঁর ধারণা।