| |
               

মূল পাতা ইসলাম চেয়ারে বসে নামায: দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া


চেয়ারে বসে নামায: দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া


ভাষান্তর: মাওলানা কবির আহমাদ কাসেমী     21 September, 2022     12:12 PM    


মসজিদগুলো এখন চেয়ারময় হয়ে যাচ্ছে। চেয়ারে বসে নামায পড়া যেন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মুসল্লিরা বিজ্ঞ মুফতীদের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। মনগড়া পদ্ধতিতেই নামায আদায় করে নেয়। যাচাই করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন কারণে অধিকাংশেরই নামায শুদ্ধ হচ্ছে না। তাই এ সম্পর্কে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত সমকালীন ফতোয়াটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

যে ব্যক্তি দাঁড়াতে এবং সেজদা করতে সক্ষম, তার জন্য নামাযে দাঁড়ানো ফরয এবং এটি নামাযের রুকন। যদি দাঁড়ানো ও সেজদার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেউ বসে ফরয নামায পড়ে, রুকন ছুটে যাওয়ার কারণে নামায হবে না। পুনরায় নামায পড়া জরুরি হবে। (ফাতাওয়া শামী: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩২)
এমনকি কেউ যদি পরিপূর্ণভাবে না দাঁড়াতে পারে, নামাযের কিছু অংশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে, তাহলে যতটুকু সময় দাঁড়াতে পারে, চাই কোনো লাঠিতে ভর দিয়ে বা দেয়ালে হেলান দিয়েই হোক না কেন—ততটুকু সময় দাঁড়ানো ফরয হবে। ততটুকু সময় যদি লাঠিতে ভর করে বা দেয়ালে হেলান দিয়ে না দাঁড়িয়ে নামায পূর্ণ করে, তাহলে নামায হবে না। 
(ফাতাওয়া শামী: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৬৭)
যদি কেউ দাঁড়াতে সক্ষম হয়, কিন্তু রুকু-সেজদা বা শুধু সেজদা করতে পারে না, তাহলে তার জন্য বসে নামায পড়া জায়েয আছে। সে ইশারার মাধ্যমে রুকু-সেজদা আদায় করবে। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ার চেয়ে বসে নামায পড়া উত্তম। (ফাতাওয়া শামী: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা৫৬৭)
অসুস্থতার কারণে অনেকের পক্ষে দাঁড়ানোটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ আছে মোটেই দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না এমন নয়, বরং দাঁড়াতে তো সক্ষম, তবে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বা অবস্থা এতটাই দুর্বল যা শরীয়তের দৃষ্টিতে উযরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-সে রোগী। দক্ষ ও অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তার বলেছে, দাঁড়ালে অসুস্থতা আরও বাড়বে বা অসুখ বিলম্বে সারবে কিংবা দাঁড়ালে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, তাহলে এসব অবস্থায় বসে নামায আদায় করা জায়েয। 
(ফাতাওয়া শামী: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৬৫)

অসহ্য যন্ত্রণা না হয়ে হালকা ও সহনীয় ব্যথা অনুভব করলে-এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে ওযর বলে গণ্য হবে না। তাই এমতাবস্থায় বসে নামায পড়া জায়েয নয়। 
(তাতারখানিয়া: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৬৭)
যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম নয়, কিন্তু যমিনে বসে সেজদার সাথে নামায আদায় করতে পারে, তাহলে তার জন্য যমিনে সেজদার সাথে নামায পড়া জরুরি। যমিনে না বসে চেয়ারের উপর বা যমিনে ইশারার দ্বারা সেজদা করা জায়েয নয়। 
(তাতারখানিয়া: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৬৭)
যদি রুকু-সেজদায় সক্ষম না হয় এবং যমিনে বসে ইশারার মাধ্যমে নামায আদায় করতে পারে, তাহলে তাশাহহুদের(আত্তাহিয়্যাতু) আকৃতিতে বসা জরুরি নয়; বরং যে আকৃতিতেই হোক, চাই মহিলাদের মতো বা আসন ধরে—যেভাবে বসা সহজ ও সম্ভব হয় সেটাকে গ্রহণ করে যমিনের উপর বসেই ইশারার দ্বারা নামায আদায় করবে। চেয়ারে বসবে না। কেননা শরীয়ত এমন অপারগদের জন্য যেভাবে সম্ভব যমিনে বসে নামায পড়ার কথা বলে তাদের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ছাড় দিয়েছে।
(ফাতাওয়া শামী: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৬৬)
এমতাবস্থায় কেউ যদি চেয়ারে বসে নামায পড়ে, তাহলে অনুত্তম হবে।

যে ব্যক্তি নামাযে দাঁড়াতে পারে না এবং রুকু-সেজদা করারও সক্ষমতা রাখে না, তবে যমিনে বসতে পারে, তার জন্য যে পদ্ধতিতে সহজ হয় সেভাবেই যমিনে বসে ইশারার মাধ্যমে নামায আদায় করা উত্তম। এমতাবস্থায় চেয়ারে বসে নামায পড়া কয়েকটি কারণে অপছন্দনীয়:
১. যমিনে বসে নামায আদায় করা হলো সুন্নাত তরীকা। সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী লোকদের আমল এর ওপরই ছিল। নব্বইয়ের দশকের পূর্ব পর্যন্ত চেয়ারে নামায পড়ার রেওয়াজ ছিল না। শ্রেষ্ঠতম তিন যুগেও এর নজির পাওয়া যায় না।
২. অপ্রয়োজনে চেয়ার ব্যবহারে কাতারে অনেক বিঘ্ন ঘটে। অথচ কাতারে মিল রাখার ব্যাপারে হাদীসে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
৩. অপ্রয়োজনে মসজিদে চেয়ার আনলে বিজাতীয়দের উপাসনালয়ের সাথে সাদৃশ্য তৈরি হয়। আর আমাদেরকে তো দ্বীনি বিষয়ে বিজাতীয়দের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে নিষেধ করা হয়েছে। 
৪. নামায হলো বিনয় ও নম্রতার নাম। আর অপ্রয়োজনে চেয়ারে বসে নামায পড়ার তুলনায় যমিনে বসে আদায় করলে নম্রতা পূর্ণরূপে পাওয়া যায়।
৫. নামাযে যমিনের নিকটবর্তী হওয়াটা কাঙ্ক্ষিত বিষয়। যা চেয়ারে বসে আদায় করলে অনুপস্থিত থাকে।
তবে কোনোভাবেই যদি যমিনে বসে নামায পড়া সম্ভব না হয়, তাহলে প্রয়োজনের নিমিত্তে চেয়ারে বসে নামায আদায় করা যাবে। অবশ্য যমিনে বসে রুকু-সেজদা করতে পারলে চেয়ারে বসে ইশারার দ্বারা নামায আদায় করা জায়েয নয়। 

যে অবস্থায় চেয়ারে বসে নামাযের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সে অবস্থায়ও ইশারার দ্বারাই সেজদা করা উচিৎ। রুকুর সময় হালকা ঝুঁকবে, আর সেজদায় আরেকটু বেশি। কোনো উঁচু জিনিস বা টেবিলে সেজদা করার প্রয়োজন নেই। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশ্রাফ আলী থানভী রহ. বলেন, ‘সেজদার সময় বালিশ বা কোনো উঁচু বস্তু সামনে রেখে সেজদা দেয়া অনুত্তম। সেজদার ক্ষমতা না থাকলে শুধু ইশারা দেবে, বালিশে সেজদা করার প্রয়োজন নেই’।
(বেহেশতি যেওর: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৫)
তাছাড়া টেবিলযুক্ত চেয়ারে কেউ টেবিলে সেজদা দিলে যাদের এমন চেয়ার নেই তাদের মনে সংশয় জাগতে পারে যে, আমরা তো কোনো বস্তুতে সেজদা দিতে পারিনি, নামাযে কমতি হলো কিনা! তাই এর থেকে বিরত থাকাই উত্তম। চেয়ারে বসে ইশারার অবস্থায় কিছু মানুষ রুকুর সময় তো হাত রানেই রাখে, কিন্তু সেজদার সময় হাত শূন্যস্থানে ঝুলিয়ে ইশারার মাধ্যমে সেজদা করে—এমনটি প্রমাণিত নয়। তাই রুকু-সেজদা উভয়টার সময়ই হাত রানে রাখবে। চেয়ারে বসে নামায পড়া অবস্থায় যেহেতু রুকু-সেজদার বিধান বাদ হয়ে যায়, সেহেতু দাঁড়ানোর বিধানও আর বাকি থাকে না। তাই চেয়ারের সামনে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং সম্পূর্ণ নামায চেয়ারে বসে পড়বে এবং চেয়ারের পেছনের পা মুসল্লিদের কাতারের বরাবর রাখবে।
এখন উপরিউক্ত অবস্থাগুলো সামনে রেখে মুসল্লিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে কী বাস্তবেই এতটা অপারগ যার জন্য চেয়ারে নামায পড়া জায়েয হবে?
যদি এমনটি না হয় তাহলে চেয়ারে নামায পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যাতে করে তার নামায শরিয়তসম্মত হয় এবং অপ্রয়োজনে চেয়ারের আধিক্যের কারণে যেন মসজিগুলো কমিউনিটি সেন্টার বা ফাংশন হল বনে না যায়।
(চান্দ আহাম আসরী মাসাইল: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১২৭-১৩২)