| |
               

মূল পাতা রাজনীতি মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ রহ.-এর কর্মময় জীবন


মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ রহ.-এর কর্মময় জীবন


মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী     23 February, 2022     10:41 AM    


বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা, রাজপথের সাহসী সিপাহসালার, বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন মর্দে মুজাহিদ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাবেক প্রধান আমীরে শরীয়ত এবং বর্ষীয়ান জননেতা মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ইং শুক্রবার সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।  ইন্তেকালের সময় তার বয়স হয়েছিলো ৭৬ বছর। তিনি ২ স্ত্রী, ৯ ছেলে ও ৮ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত-মুরীদ ও গুণ-গ্রাহী রেখে গেছেন। একই দিন বাদ আছর কামরাঙ্গীরচরস্থ জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়ার ময়দানে মরহুমের নামাজে জানাযার পর নিজ পিতা কুতুবে আলম হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর পাশে তাকে দাফন করা হয়। নামাজে জানাযায় ওলামায়ে কেরাম ও জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ প্রায় লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল। উল্লেখ্য, পরপর কয়েক বার ব্রেন স্ট্রোক এবং ডায়াবেটিকসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের মার্চ মাস থেকে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন তিনি।

ইসলামী আন্দোলনের দুঃসাহসী সিপাহসালার মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, ইসলাম ও দেশ বিরোধী যে কোন তৎপরতার বিরুদ্ধে সর্বদা প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা রক্ষায় ভন্ড নবীর দাবিদার কাদিয়ানী, ভণ্ডপীর দেওয়ানবাগী, এনজিও, নাস্তিক তসলিমা নাসরিন ও আহমদ শরীফসহ সকল মুরতাদ ও বাতিলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে হক কথা বলতে ভয় ও সংকোচ করতেন না তিনি। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও গণমানুষের অধিকার আদায়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় তাঁর কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামে।

মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ ঈমান-আক্বীদা সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি, সমমনা ইসলামী দলসমূহ ও ইসলামী-সমমনা ১২ দলের সংগঠক, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীরসহ বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইসলাম বিরোধী তৎপরতা এবং শাসকদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১২ইং সালে ২২ সেপ্টেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। ২৩ সেপ্টেম্বর মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বার বার ইসলামের মর্যাদা রক্ষা এবং জনগণের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে ভূমিকা রাখেন তিনি।

জন্ম ও বংশ পরিচয় : বিশ্ব বরেন্য আলেম ও বুজুর্গ রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক রাহবার আমীরে শরীয়ত হযরত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বড় সাহেবজাদা মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ ১৯৪২ সালে রাজধানী ঢাকার লালবাগ কিল্লারমোড়স্থ বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। দাদার নাম মাওলানা ইদরীস সাহেব। তিনি উর্দূ-ফার্সি ভাষায় সুদক্ষ ও সমাজে সুপরিচিত আলেম ছিলেন। পরদাদা মাওলানা মুন্সি আকরাম উদ্দিন রহ, ছিলেন বালাকোটের শহিদ সৈয়দ আহমেদ বেরলভী রহ.এর সুযোগ্য খলিফা।

শিক্ষাজীবন : মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ প্রথম সবক ও প্রাথমিক শিক্ষা পিতা হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কাছেই গ্রহণ করেন। পরে নিজ পিতা এবং আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির তত্ত্বাবধানে বড়কাটারা, লালবাগ ও মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় ইলমে দ্বীন শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর ইলমে নববীর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনে করাচীর জামিয়া ইসলামিয়া বিন নূর টাউন মাদরাসায় ভর্তি হন। মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ছাত্র জামানা থেকেই বড় বড় ওলামায়ে কেরামের কাছে আসা-যাওয়া করতেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সন্তান হিসেবে সবাই তাঁকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। যেই সকল যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের সান্নিধ্য লাভে তিনি ধন্য হন তারা হলেন- বিশ্ববরেণ্য আলেম আল্লামা ইউসুফ বিন নূরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি হাফিজুল হাদীস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারীয়ান আল্লামা মুফতি মাহমূদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মুফতি শফি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী ও মুফতি সলীমুল্লাহ খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমূখ। পাকিস্তানের বিশিষ্ট পার্লামেন্টারীয়ান জমিয়ত নেতা মুফতি মাহমুদরাহমাতুল্লাহি আলাইহি ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন তিনি। সে সুবাদে ছাত্র জীবন থেকেই মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্যে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সাথে কাজ করেন।

May be an image of 5 people

কর্ম জীবন : পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ১৯৬৩ সালে হযরত হাফেজ্জী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রধান মুয়াজ্জিন হিসেবে খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া, আমীনবাজার মদিনাতুল উলূম মাদরাসা ও লক্ষীপুর লুধুয়া এশাআতুল উলূম মাদরাসার একই সাথে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও দেশের অসংখ্য মাদরাসার মুরুব্বী ছিলেন তিনি।

কামরাঙ্গীরচর মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ : হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তেকালের পর মাওলানা ক্বারী আহমাদুল্লাহ আশরাফ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপিঠ জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়ার মুহতামিম পদে নিযুক্ত হন। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ যাবৎ মাদরাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছে। অসুস্থতা ও কর্ম অক্ষমতার কারণে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর খেলাফত আন্দোলনের প্রতিনিধি সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়তের দায়িত্ব এবং ২০১৫ সালের ৬ আগষ্ট জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়ার মুহতামিমের দায়িত্ব তার ছোট ভাই মাওলানা ক্বারী শাহ আতাউল্লাহ দা.বা.এর কাছে হস্তান্তর করেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি মাদরাসার সারপুরস্তে আ’লা ছিলেন।

সুমধুর আযান : মাওলানা ক্বারী শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ সমধুর কণ্ঠে বহুবছর আযান দিয়েছেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। তাঁর আযানে মানুষের অন্তরকে প্রকম্পিত করত। একবার তিনি মক্কা শরীফে মসজিদুল হারামে আযান দিয়েছিলেন। এ আযানে বিশ্ব পরিমণ্ডলেও তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছিলো। আযানের যে ইলহান এখনও বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত তা তাঁরই কণ্ঠনি:সৃত আযানের প্রতিধ্বনি।

রাজনৈতিক জীবন : মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফের জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে রাজনীতির ময়দানে। ছাত্র জীবন থেকেই আল্লাহর জমীনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্যে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামসহ বিভিন্ন দ্বীনী সংগঠনের কাজে সহযোগিতা করেন। ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির তওবার রাজনীতির আন্দোলনে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

খেলাফত আন্দোলনের আমীর নির্বাচিত : হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, আমার আকাক্সক্ষা- খেলাফত আন্দোলন যেন একদিনের জন্যও আমীরবিহীন না থাকে এবং আমার জানাজা যেন ‘আমীরের’ অধীনে হয়। হযরত যখন অসুস্থ হয়ে যান তখন বললেন, ‘আমি আমার অবর্তমানের জন্য অতি সাময়িকভাবে আমার বড় বেটা মিয়া ক্বারী আহমাদুল্লাহকে আমার ক্বায়েম মুক্বাম করে দিলাম। পরবর্তীতে আপনারা কোন যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করতঃ এ মহা গুরু দায়িত্বভার তার হাওয়ালা করবেন। ও তাঁর জন্য সকলে দোয়া করতে থাকবেন।’

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তেকালের পর তাঁর আকাক্সক্ষা মোতাবেক অস্থায়ীভাবে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ সংগঠনের দায়িত্বশীল হন। হযরতের জানাজার পূর্বাহ্ণে মরদেহের উপস্থিতিতে ৮ ই রমজান ১৪০৭ হিজরী, ৭ই মে ১৯৮৭ ইং শুক্রবার সকাল ৯টায় জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় সমবেত দলের নেতা ও কর্মীদের এক সভা খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর হযরত মাওলানা ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে এই প্রথম গুরু দায়িত্ব নিতে হয়। পরবর্তীতে ১ মাস ২৭ দিন পর ৬ জিলক্বদ মাদরাসা-ই নূরিয়ায় আহুত দলের ঐতিহাসিক সর্ববৃহৎ মজলিসে শূরায় তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আমীরে শরীয়ত’ নির্বাচিত হন এবং এ অধিবেশনেই সকল সদস্যদের বায়আ’ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ থেকে গত ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ইং তারিখ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসী ভূমিকা : ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাাকাও। ক্ষুদ্র, অসহায় ব্যবসায়ীদের উপরে পাক বাহিনী যখন জুলুম-নির্যাতন করছিল, তখন মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ বীরবিক্রমের মত তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এবং সরাসরি পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। এক পর্যায়ে তারা মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে গ্রেপ্তার করে যাত্রাবাড়ী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বন্দুক তাক করে দাড় করানো হয়েছিল। আল্লাহ তা’আলার মেহেরবানীতে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ রক্ষা পান।

১৯৯০ সালে ভারতের বাবরী মসজিদে উগ্র হিন্দুদের হামলার প্রতিবাদে তিনিই এরশাদ সাহেবের জরুরী অবস্থা ভঙ্গ করে হাজার হাজার মানুষের বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ২০০১ সালের ফতোয়া বিরোধী হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এবং কুরআনবিরোধী নারী নীতিমালা’র বাতিলের দাবীতে ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। ২০০৭ইং সালের দিকে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা কর্তৃক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপা’র প্রতিবাদে তৎকালীন সময়ে সর্বপ্রকার মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ থাকা সত্তে¡ও জীবন বাজি রেখে সকল প্রকার ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে খেলাফত আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে সর্বপ্রথম তিনিই বায়তুল মোকাররম উত্তরগেটে বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন এবং পরবর্তীতে এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কুরআন বিরোধী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি জোরদার ভূমিকা রাখেন। নান্তিক-মুরতাদ-ব্লগার কর্তৃক কুরআন-সুন্নাহ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটুক্তি করায় খেলাফত আন্দোলনের ব্যনারে নান্তিকদের শান্তির দাবীতে তিনিই সর্বপ্রথম আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর আহ্বানেই ২২ ফেব্রুয়ারী ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এ বিক্ষোভে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বাঁধার প্রতিবাদে তিনি ২৪ ফেব্রুয়ারী সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেন। যা সারা দেশে নজীরবিহীন স্বত:স্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। এ হরতালে মানিকগঞ্জে ৫জনসহ সারাদেশে ১০ জন ধর্মপ্রাণ মানুষ পুলিশের গুলিতে শাহাদতবরণ করেন। পরবর্তীতে এ আন্দোলন ‘হেফাজতে ইসলামে’র নেতৃত্বে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লে হেফাজতের ব্যনারেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

কারাবরণ :  ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নারী নীতিমালা ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে আন্দোলনরত অবস্থায় জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ গ্রেফতার হন। তাঁর গ্রেফতারির প্রতিবাদে পরের দিন সারা দেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল ও বিক্ষোভ পালিত হয়। মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে খেদমতকালীন বাইতুল মুকাররমের দক্ষিণ গেইট সংলগ্ন একটি ক্লাবে মদ ও জুয়ার আসর বসত। মাওলানা আশরাফ একদিন জুমার নামাযের পর মুসল্লীদের নিয়ে এর জোড়ালো প্রতিবাদ করেন। তৎকালীন সরকার তখন তাঁকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে মুসল্লীদের আন্দোলনে সরকার তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

বাতিল প্রতিরোধে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ:  অন্যায় ও বাতিল প্রতিরোধে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ছিলেন এক দুঃসাহসী সিপাহসালার। সকল জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদা তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।

  • ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে এবং ১৯৯৪ সালে নাস্তিক তসলিমা নাসরিনের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে জেড়ালো ভ‚মিকা রাখেন।
  • ২০০১ সালের ফতোয়া বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
  • ২০০৭ দৈনিক প্রথম আলো কর্তৃক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপা’র প্রতিবাদে সর্বপ্রকার মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ থাকার পরেও জান বাজি রেখে সকল প্রকার ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে খেলাফত আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে সর্বপ্রথম তিনিই বায়তুল মোকাররম উত্তরগেটে বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন এবং পরবর্তীতে এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
  • ২০০৭ সালে কুরআনবিরোধী নারী নীতিমালা’র বাতিলের দাবীতে ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন।
  • কুরআন বিরোধী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি জোরদার ভূমিকা রাখেন।
  • ২০১৩ নাস্তিক-মুরতাদ-ব্লগার কর্তৃক কুরআন-সুন্নাহ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটুক্তি করায় খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে নাস্তিকদের শাস্তির দাবীতে তিনিই সর্বপ্রথম আন্দোলনের ডাক দেন। পরবর্তীতে এ আন্দোলন ‘হেফাজতে ইসলামে’র নেতৃত্বে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লে হেফাজতের ব্যানারেও তিনি নেতৃত্ব দেন।
  • এছাড়াও বিভিন্ন সময় মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা রক্ষায় ভন্ডপীর, দেওয়ানবাগী, মাইজভান্ডারী, আটরশি, সুরেশ্বরীসহ বাতিল পীরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

চরিত্র-মাধূর্য্য : মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ শৈশবকাল থেকেই উত্তম চরিত্র, সদ্ব্যবহার, সহনশীলতা, সবর, উদারতার গুণের অধিকারী, মিশুক ও সদালাপী ছিলেন। সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সবশ্রেণীর মানুষের সাথে কথা-বার্তা বলতেন এবং ধৈর্যসহকারে নেতা-কর্মী, শিক্ষক-ছাত্র ও সাধারণ মানুষের কথা শুনতেন। মানুষকে কাছে টেনে নিতেন। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সবাই তাকে সম্মান করতেন।

গরীব-দুঃখীর পাশে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ : এতীম, অসহায়, গরীব-দুঃখীর জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। রান্তা থেকে এতীম-গরীব, অসহায়দের কুড়িয়ে এনে অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। যাদের অনেকেই আজ কুরআনুল কারীমের হাফেজ, মাওলানা হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ রহ. এর কথা স্মরণ হলেই স্মৃতিতে ভেসে উঠে একটি আপোষহীন নির্লোভ, নিরহঙ্কার, মানবদরদী সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন সাহসী রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, খাদেমী দ্বীন। হককে হক এবং বাতিলকে বাতিল বলতে যিনি ছিলেন সোচ্চার। আজীবন কোরআন-সুন্নাহ তথা হক্কানিয়্যাতের আওয়াজ বুলন্দ করাই ছিল যার নেশা ও পেশা। সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে দ্বীনের জিম্মাদারী হিসেবে আমৃত্যু নায়েবে রাসূলের দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। ইসলামী রাজনীতির নেতৃত্বের জন্য সবধরনের গুণাবলিই ছিল তার মাঝে সমুপস্থিত। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রখর যুক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। নেতৃত্ব দিলেও প্রচলিত ধোকা-প্রতারণার রাজনীতিতে ভেসে যাননি। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কোনো আপোষ করেন নি। ইসলামী আদর্শ ও শরীয়তের বিধানকে জলাঞ্জলি দেননি তিনি। তওবা ও জিকরুল্লাহর রাজনীতির প্রবতর্ক হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর চিন্তাধারা বাস্তবায়নে ওলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁর জীবনকর্ম ইসলাম, দেশ ও জাতির খেদমতে আত্মত্যাগ করার অনুপ্রেরনা জোগায়। আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল দ্বীনী খেদমত কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উঁচু মাকাম দান করুক। আমিন।

লেখক : শিক্ষক, রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক