মূল পাতা সোশ্যাল মিডিয়া বয়স্করা খানকায়, তরুনদের কাজ ময়দানে
সৈয়দ শামছুল হুদা 10 December, 2020 07:14 PM
কুরআনের প্রতিটি আয়াতের মধ্যে আলাদা একটি স্বাদ আছে। আপনি যখনই কুরআনের প্রতিটি আয়াতকে নিজের সাথে, নিজের পরিবেশের সাথে, রাষ্ট্রের সাথে, বর্তমান অবস্থার সাথে মিলাবেন, তখন দেখবেন কুরআন আপনাকে অন্যরকম শক্তি যোগাচ্ছে। ইসলাম যেহেতু সর্বকালের সেরা ধর্ম, কুরআন যেহেতু কিয়ামতের পুর্ব পর্যন্ত সকল মানুষের সকল সমস্যার সমাধান সেহেতু কুরআন থেকেই আপনি পথ চলার প্রেরণা পাবেন। আমরা কুরআনি নির্দেশনা ভুলে যাওয়ার কারণেই হতাশায় ভোগি। আমরা দিশা হারিয়ে ফেলি। কুরআন সব পরিবেশের জন্য, সব মানুষের জন্য, সকল যুগের জন্য অতি আধুনিক কৌশল আপনাকে জানাবে। কুরআনি নির্দেশনার বাইরে এরচেয়ে উন্নত কোন করণীয় কেউ আমাদের দিতে পারবে না। হতে পারে না।
আজকে একটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো, যে আয়াতটি সবসময়ই আমাকে খুব উৎসাহ দেয়। প্রেরণা যোগায়। সাহস যোগায়। যদিও এর প্রকৃত আবেদন বোঝার মতো জ্ঞান আমার নেই। বুঝানোর মতো শব্দশক্তিও আমার নেই। তারপরও পবিত্র কুরআনের সুরা আনফাল এর ৬০নাম্বার আয়াতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে মনে হয়। ইসলামী দলগুলোর জন্য, মুসলিম শাসকদের জন্য এখানে রয়েছে করণীয় নির্দেশনা। আয়াতটিকে আমরা খুব সংক্ষিপ্ত অর্থে হয়তো ব্যবহার করি। আমি মনে করি, এর ব্যাপক আবেদন রয়েছে। আসুন, বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে কুরআনের এই আয়াতটিকে আমাদের প্রয়োজনে কাজে লাগাই।
আল্লাহ তায়ালা বলেন :
واعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل، ترهبون به عدو الله وعدوكم وآخرين من دونهم، لا تعلمونهم، الله يعلمهم، وما تنفقوا من شيئ في سبيل الله يوف اليكم وانتم لا تظلمون.
অর্থ:
তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য জন্যে যথাসাথ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যা দ্বারা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করবে, এ ছাড়া অন্যান্যদেরকেও। যাদেরকে তোমরা জান না কিন্তু আল্লাহ জানেন; আর তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় কর তার প্রতিদান তোমাদেরকে পুরোপুরি দেয়া হবে, প্রতিদান দেওয়ার ক্ষেত্রে তোমাদের প্রতি কোন প্রকার জুলুম করা হবে না। (সুরা আনফাল : ৬০)
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিস্কার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন যে, তোমরা তোমাদের সামর্থের ভিতর সবসময় এমন প্রস্তুতি গ্রহন করো যাতে তোমাদের জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত শত্রুরা ভয়ে তটস্থ থাকে। আমি মনে করি, এই আয়াত দ্বারা রাষ্ট্রের প্রতি যেমন নির্দেশনা রয়েছে, তেমনি প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি ইসলামী দল এর প্রতিও নির্দেশনা রয়েছে। এই আয়াতের আলোকে মুসলিম দেশের সরকারের ওপর ফরজ যে, তারা সমসাময়িক বিশ্বে সর্বোচ্চ মানের অস্ত্রের অধিকারী হবে। অস্ত্রের আবিস্কার, সামরিক গবেষণা ইত্যাদি কাজ রাষ্ট্রের জন্য আল্লাহর হুকুমে ফরজ দায়িত্ব। আর এক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার অঙ্গীকার এই যে, কোন রাষ্ট্র যদি শুধু আল্লাহ তায়ালার এই বিধানের ওপর বিশ্বাস করে সামরিক শিল্পে যারপর নাই উন্নতি করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা এর প্রতিটি অর্থের বিনিময়ে অনেক বেশি পুরস্কার দিবেন।
কোন ইসলামী দল যদি এমন প্রস্তুতি নেয় তাহলে তাকেও আল্লাহ তায়ালা পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আয়াতে প্রস্তুতির জন্য কোন রাষ্ট্র থাকার কথা বলা হয়নি। সকল ইসলামী জনশক্তির জন্য এই নির্দেশ। এই আয়াতের আলোকে ইসলামী দলগুলোর উচিত, শত্রুরা ভয় পায় এমন সার্বিক শক্তি অর্জন করা। সেটা হতে পারে প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরী করা, শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়ে তোলা অথবা অন্য এমন যে কোন পদ্ধতি যেটাকে আল্লাহর শত্রুরা ভয় পায়। বলিষ্ট কণ্ঠে টকশোতে বাতিলকে কুপোকাত করার যোগ্যতা অর্জন করা, শক্তিশালী কলাম লেখা, ইউটিউবে শক্তিশালী ভিডিও আপলোড করা সবকিছুই হতে পারে। মোট কথা যোগ্যতা ও সামর্থ অর্জন করা। কারো পিছনে মিন মিন করে চলা নয়। আল্লাহর কোন বান্দা, ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত কোন দল, কোন রাষ্ট্র অমুসলিমদের অনুসরণ করতে পারে না। ইসলামের প্রকাশ্য শত্রুদের সাথে আপোষ করে চলতে পারে না।
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানরা শত্রুর হাতের খেলার পুতুল। এর একমাত্র কারণ হলো, কুরআনি বিধান না মানা। শত্রুকে চিনতে না পারা, শত্রুকে চিনলেও তাদের ব্যাপারে অন্তরে ভীতি লালন করা ইত্যাদি আমাদেরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আরো সমস্যা হলো, আমরা যখন বুঝি তখন একরোখা বুঝ বুঝি। কেউ কেউ এই আয়াত পড়ে মনে করবে, এখনই অস্ত্র নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাপিয়ে পড়তেই বুঝি এখানে বলা হয়েছে। আসলে আমার মনে হয় এমনটা ঠিক নয়।
যোগ্যতা, সামর্থ, শক্তি অর্জনের অর্থ শুধুই অস্ত্র নয়। শত্রুকে ভীত করা যায়, সন্ত্রস্ত করে রাখা যায় এমন সকল পদ্ধতিই শক্তি অর্জনের অর্থ বহন করে। কখনো মুসলমানদের ঐক্য, কখনো ভালো বক্তা, কখনো ভালো লেখক, কখনো শক্তিমান কোন কবি, কখনো সামরিক শিল্পের অসাধারণ আবিস্কার, কখনো শক্তিশালী কোন মিডিয়া তৈরী সবকিছুই শত্রুকে ভীত করার জন্য প্রয়োজন হয়। শত্রুকে ভীত করতে পারাটাই আসল উদ্দেশ্য।
শক্তি অর্জনের জন্য কখনো সামনে কোন প্রকাশ্য শত্রু থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। মুসলমানরা কখনো অসতর্ক থাকতে পারে না। এটাই এই আয়াত দ্বারা পরিস্কার। অনেক সময় আমরা আমাদের শত্রু কে? সেটা ঠিক করতে পারি না। দেখা গেলো, ঘরের ভিতরেই শত্রুর বাস। এই জন্যই আয়াতে বলা হয়েছে, তুমি চিন বা না চিন, এমন সকল শত্রুর জন্যই তোমার সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
আয়াতটা যতবার পড়ি, ততবার প্রেরণা লাভ করি। সাহস পাই। আজকের তুরস্কের দিকে তাকালে এই আয়াতটির কথা মনে পরে। বর্তমান তুরস্ক শত্রুকে নানান ভাগে ভাগ করেছে। একেকটি শত্রুর সাথে একেকরকম আচরণ করছে। দূর থেকে আমরা এসব বহুমুখি আচরণের তীব্র সমালোচনাও করছি। আসলে সব শত্রুর সাথে সব অস্ত্র ব্যবহার করা যায় না। তুরস্ক কখনো কূটনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করছে, কখনো সাংস্কৃতিক অস্ত্র ব্যবহার করছে। কখনো সরাসরি সামরিক অস্ত্রের ব্যবহার করে শত্রুকে ভীত রাখছে। কখনো ইসলামের প্রকাশ্য শত্রুর সাথে মাখামাখিও করছে। এর পেছনেও নানা হিসাব নিকাশ আছে।
বাংলাদেশের আলেম সমাজ যতদিন সামগ্রিক অস্ত্রের ব্যবহারে কৌশলী হয়ে উঠতে না পারবে ততদিন আমাদের জিল্লতি দূর হবে না। শত্রুর সাথে কখনো হাতমিলিয়ে ঘায়েল করতে হবে, কখনো গালে থাপ্পর লাগিয়ে ঘায়েল করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দেশের যোগ্য আলেমদের নেতৃত্ব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য তরুন, মেধাবী, কর্মক্ষম নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। বয়স্কদের শুধু দুআ ও বরকতের জন্য রেখে দিতে হবে। সকল বয়স্কদের মূল দায়িত্ব থেকে দূরে রাখতে হবে। বয়স্করা নিজ নিজ খানকায় তাযকিয়ার কাজ করবেন। ময়দানে মেধাবী তরুনরা নেতৃত্ব দিবে। ঐক্য গড়ে তুলবে।
এসব কুরআনি নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য মুসলমানদের ঐক্য খুব জরুরী। ঐক্য বিনাশী সকল তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। দেশের বর্তমান আলেম সমাজের সামনে কাজের ক্ষেত্র খুব সীমিত বলেই এত কাদা ছুঁড়াছড়ি। দল ভাঙ্গাভাঙ্গি। কাজ করলে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে এত দল হতো না। এত বিভক্তি আসতো না। ইসলামের শত্রুরা এতটা বেপরোয়া হয়ে আলেম-উলামাদের সামনে কথা বলতে পারতো না। আমাদের দুর্বলতার কারণে আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও শত্রুরা আমাদেরকে নিয়ে খেলে। তামাশা করে। ব্যঙ্গ কার্টুন আঁকার সাহস পায়। আমাদের জ্ঞানের অভাব, দূরদর্শিতার অভাব, যোগ্যতার অভাব। এর ওপর রয়েছে আত্মঅহমিকা, আত্ম প্রবঞ্চনা, আত্মম্বরিতা। আমাদের অনেকের মাঝে রয়েছে ঔদ্ধত্ব আচরণের স্বভাব। আমরা অনেকেই শত্রুর কাছে খুব দুর্বল আর আপন ভাইদের কাছে খুব সবল। সামান্য ভিন্নমত প্রকাশের কারণে ভাইয়ের ওপর হামলে পড়ি। এসবই আমাদের দুর্বলতার কারণ। আর সেজন্যই বয়স্কদের দুআর জায়গায় বসিয়ে রেখে যোগ্য তরুনদেরকে সামনে আসতে হবে। বড় বড় দায়িত্ব তরুনদের নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে।
কুরআনি বিধান বাস্তবায়নে তরুনদের যতটকু সামর্থ আছে বয়স্কদের তা নেই। পৃথিবীতে যত বড় বড় আবিস্কার, গবেষণা, ঘটনা ঘটেছে, সব তরুনদের হাত ধরেই। বাংলাদেশেই কেবল উল্টো পথে। এখানে মেধাবী তরুনদের কোন কাজ নেই। নেতৃত্ব নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহনের কোন ক্ষমতা নেই। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যাওয়ার পরেই এখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমরাও বুড়োদের ছাড়া মান্য করতে আগ্রহী হই না। অথচ ময়দানের কাজ তরুনদের। বুড়োদের নয়। আজকের ইস্তাম্বুলে মাহমুদ এফেন্দীদের ফুয়ুজ ও বরকত নিয়ে এরদোয়ান, আব্দুল্লাহ গুল প্রমুখরা কাজ করছে। একে পার্টিতে অনেক তরুন এমপি আছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক: জেনারেল সেক্রেটারী, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট 'বিআইএম'