মূল পাতা বিশেষ প্রতিবেদন রাশিয়ায় দৃষ্টিনন্দন পাঁচ মসজিদ
শেখ আশরাফুল ইসলাম 29 November, 2024 09:17 PM
রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। বর্তমানে ১৪ কোটি ৬০ লাখ রুশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। কেবল রাজধানী মস্কোতেই মুসলমান রয়েছে ১০ লাখ। স্থাপত্য নকশায় অনিন্দ্য সুন্দর অনেক ঐতিহাসিক ও প্রাচীন মসজিদ রয়েছে দেশটিতে। এই প্রতিবেদনে থাকছে রাশিয়ার সেই দৃষ্টিনন্দন পাঁচটি মসজিদের বিস্তারিত।
তালিকার প্রথমেই রয়েছে “আহমাদ কাদিরভ মসজিদ”
এটি চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে ১৪ একরের বিশাল একটি সুসজ্জিত পার্কে সাজনা নদীর তীরে অবস্থিত। ২০১৫ সালের আগে দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ। ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপস্থিতিতে চেচেন নেতা রমজান কাদিরভের বক্তব্যের মাধ্যমে মসজিদটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
মসজিদটি উসমানি স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। মসজিদের প্রধান গম্বুজের উচ্চতা ৩২ মিটার। সেই সাথে ৪ কোনায় রয়েছে ৬৩ মিটার উচ্চতার চারটি সুউচ্চ মিনার। মূল মসজিদের বাইরের বারান্দায় রয়েছে ১৭ ছোট ছোট গম্বুজ। সম্পূ মসজিদ মার্বেল পাথরে ঢাকা। মসজিদের ভেতরের অংশে সাদা মার্বেল পাথর তার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
৫০০০ বর্গ মিটার আয়তনের মসজিদটিতে এক সঙ্গে ১০ হাজারের বেশি লোক নামাজ আদায় করতে পারে।
আমরা এই তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছি তাতার মুসলিমদের ইতিহাস সমৃদ্ধ “কুল শরীফ মসজিদ”
রুশ ফেডারেশনভুক্ত একটি মুসলিম প্রজাতন্ত্র তাতারিস্তান। এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মুসলমান। কাজান এই প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। আর এই কাজানেই অবস্থিত তাতার মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিখ্যাত কুল শরিফ জামে মসজিদ।
দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদ নির্মাণ করা হয় খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে। ১৫৫২ সালে রুশ বাহিনীর আক্রমণ থেকে কাজান শহর রক্ষার জন্য সংঘটিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শহীদ ও প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ‘কুল শরিফ’-এর নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়। মুঘল, তাতার এবং ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে এটি নির্মত।
মসজিদটির গম্বুজ, মিনার এবং অভ্যন্তরের নকশা অত্যন্ত সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। গম্বুজগুলোতে নীল, সোনালী এবং সাদা রঙের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। মসজিদটিতে বিশালাকৃতির একটি প্রধান গম্বুজ রয়েছে এবং তার পাশে রয়েছে দুটি মিনার । এটি রাশিয়ার অন্যতম বড় মসজিদগুলির মধ্যে একটি। সুবিশাল এই মসজিদের আয়তন ১৯ হাজার বর্গমিটার। মসজিদের ভিতরে নামাজ আদায় করতে পারে ৫ হাজার মুসল্লি। সেই সাথে মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে প্রায় ১০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।
তালিকার তৃতীয় অবস্থানে “সেন্ট পিটার্সবার্গ কেন্দ্রীয় মসজিদ” যেটি “নীল মসজিদ” পরিচিত
রাশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরচিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেন্ট পিটার্সবার্গ নগরীতে এই মসজিদটি অবস্থিত। বাল্টিক সাগরের অন্তর্গত ফিনল্যান্ড উপসাগরের মোহনায় নেভা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরকে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটনকেন্দ্র বলা হয়।
সেন্ট পিটার্সবার্গের মুসলমানরা রুশ সাম্রাজ্যের রাণী ক্যাথেরিনের শাসনকালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইবাদত করতে পারত। কারণ, তারাই ছিল ওসমানি খিলাফত ও বুখারা সমরকন্দের সঙ্গে রাশিয়ায় যোগাযোগের বিশ্বস্ত মাধ্যম। এতদসত্ত্বেও তখন তাদের জন্য মসজিদ নির্মাণের অনুমতি ছিল না। প্রত্যেকে নিজ নিজ ঘরে নামাজ আদায় করত।
১৮৮১ সালে বুখারার আমির পুত্র পিটার্সবার্গ সফরকালে মসজিদ নির্মাণের জন্য অনুমতি চান। কিন্তু তৎকালীন সরকার সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেয়। ১৯০৪ সালে মসজিদ নির্মাণের আবেদনে সম্মতি জানিয়ে বুখারার আমিরকে চিঠি প্রেরণ করে সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস। তখন তিনি মসজিদের জন্য জায়গা কেনেন। তবে পুনরায় বাধা দেওয়ায় নির্মাণকাজ স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে নির্মাণের অনুমতি পেয়ে ১৯১০ সালে শুরু হয়ে তিন বছরের মাথায় শেষ হয়।
এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বুখারা ও সমরকন্দের মসজিদগুলোর আদলে। মসজিদের দেয়ালের ভেতরে ও বাহিরে সজ্জিত করা হয় নীল মোজাইক দিয়ে। মসজিদে দুটি মিনার রেয়েছে। সেগুলোতেও হালকা নীল রঙের মোজাইক করা হয়। মসজিদের দেয়ালে ও বিভিন্ন জায়গায় পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা নান্দনিক ক্যালিগ্রাফি করা।
১৯১৩ সালে বুখারার আমির মীর মুহাম্মদ আমির আলী খানের উপস্থিতিতে এই মসজিদ উদ্বোধন হয়। সেই সময় এটি ছিল তুরস্কের বাইরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ।
তালিকার চতুর্থতে রয়েছে টিউলিপ ফুলের আদলে তৈরি “লালা তুলপান মসজিদ”
মসজিদটি রাশিয়ার উফায় অবস্থিত। দেশটির বিখ্যাত একটি ফুলের নাম টিউলিপ। বসন্তের ফুটন্ত সেই ফুলের আদলেই তৈরি করা হয়েছে মসজিদটি। এই মসজিদটি আধুনি স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হয়েছে। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে পবিত্র এই মসজিদ। অনেকের কাছে এটি “টিউলিপ মসজিদ”হিসেবেও পরিচিত।
১৯৯০ সালে লালা তুলাপান মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। টানা আট বছর নির্মাণ কাজ শেষে ১৯৯৮ সালে মসজিদটিকে নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
শুধু লম্বা মিনার ও টিউলিপ আকৃতি নয়, মসজিদের অভ্যন্তরে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে স্থাপন করা হয়েছে রঙিন কাঁচের জানালা। মসজিদের দেয়ালে গাছ ও ফুলের চিত্র সুন্দরভাবে আঁকা হয়েছে। একসঙ্গে ১ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন এই মসজিদতে। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে রাশিয়ার অন্যতম মসজিদ লালা তুলপান।
তালিকার পঞ্চম অর্থাৎ সর্বশেষে রয়েছে “মস্কো কেন্দ্রীয় মসজিদ”
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে অবস্থিত দেশটির অন্যতম বৃহত্তম এবং গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ এটি। মসজিদটি আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হয়েছে।
১৯০৪ সালে তাতার মুসলিমদের প্রচেষ্ঠায় নির্মিত হয় এই মসজিদ। পরে মসজিদটি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় এবং বেশি সংখ্যক মুসল্লি ধারণ করতে না পারায় এটি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০১১ সালে পুরোনো মসজিদটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু হয়। পুনর্নির্মাণকাজ শেষে ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নতুন করে মস্কো মসজিদের উদ্বোধন হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এবং ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস উপস্থিত ছিলেন।
মসজিদের প্রধান গম্বুজটির উচ্চতা প্রায় ৪৬ মিটার। মসজিদে দুটি প্রধান মিনার রয়েছে, যার প্রতিটির উচ্চতা ৭২ মিটার। এতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি এবং ঐতিহ্যবাহী নকশা ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে দেখতে বেশ নয়নাভিরাম। মসজিদের ভেতরের অংশ মার্বেল পাথর এবং স্ফটিক দিয়ে সুসজ্জিত। ভেতরেও রয়েছে ক্যালিগ্রাফি নকশা। মস্কোর এই মসজিদে একসাথে দশ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।