| |
               

মূল পাতা রাজনীতি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের মেয়াদ কতদিন চায় বিএনপি?


নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের মেয়াদ কতদিন চায় বিএনপি?


রহমত নিউজ ডেস্ক     25 September, 2023     09:01 AM    


গত দুমাসেরও বেশি সময় ধরে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। সরকার পতনের আন্দোলনে আসার কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় সরকার না থাকলে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলটি নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বেশ সময়সাপেক্ষ। বিএনপি নির্বাচন পরিচালনার জন্য দুই-তিন মাস নয়, বরং এক বছর বা তারও বেশি মেয়াদের অন্তবর্তীকালীন সরকার চায় কি-না রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সেই প্রশ্ন উঠছে। এমনকি বিএনপি যে নির্দলীয় সরকারের কথা বলছে তার বিস্তারিত কোন রূপরেখা দেয়া হয়নি তাদের পক্ষ থেকে। সেই সরকারে কারা থাকবেন সেটাও স্পষ্ট নয়।

তত্ত্বাবধায়ক’ থেকে নিরপেক্ষ সরকার
বিএনপি সম্প্রতি যে আন্দোলন শুরু করেছে সেটার সূত্রপাত এক বছর আগে। গত বছরের অগাস্টে বিএনপি দেশজুড়ে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ শুরু করে। তবে তখন সেসব বিক্ষোভের মূল দাবি ছিল জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির প্রতিবাদ। গত বছরের ২২ অগাস্ট থেকে শুরু হয়ে সেসব কর্মসূচি চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বিএনপি’র বিক্ষোভে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিও দেখা যায়। পরে অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ বিভাগে ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশ করে বিএনপি। এসব সমাবেশে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় 'নেতা-কর্মীদের হত্যার বিচার', খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিভাগীয় সমাবেশের শেষটি হয় ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর। নানা নাটকীয়তার মধ্যে অনু্ষ্ঠিত হওয়া সেই মহাসমাবেশে আন্দোলনের ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে বিএনপি। দশ দফা দাবিতে দলটি মূলত: ৩টি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং খালেদা জিয়াসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তি। দশ দফা দাবি নিয়ে ছয় মাসেরও বেশি সময় আন্দোলনের পর চলতি বছরের ১২ জুলাই সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে যায় বিএনপি। তবে এই সময়ের মধ্যে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ শব্দটির পরিবর্তে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অন্তবর্তীকালীন ‘নির্দলীয়’, ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। তবে নাম যেটাই হোক, বিএনপি যে একধরণের অন্তবর্তীকালীন সরকারের কথা বলছে সেটা স্পষ্ট।

নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা কী?
বিএনপি শুরুতে অতীতের আদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে আসলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেটা সবসময়ই নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি এরকম একটি সরকারের বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকেও দৃশ্যত কোন বক্তব্য বা চাপ আসেনি। ফলে একপর্যায়ে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকাররে' বদলে বিএনপি ‘নির্দলীয়’ বা ‘নিরপেক্ষ' সরকারের কথা বলতে শুরু করে। যদিও সেই সরকারে কারা থাকবে এবং কিভাবে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন রূপরেখা দিতে পারেনি দলটি। যদিও এটাকে এখনই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে কোন ধরণের লোক বসবে সেটা এখনি গুরুত্বপূর্ণ নয়। নির্দলীয় সরকারে রাজনৈতিক ব্যক্তি, নাকি অরাজনৈতিক ব্যক্তি, নাকি একাডেমিশিয়ান থাকলো এটা আসলে মূল প্রশ্ন নয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, যারা সেই অন্তবর্তীকালীন সময়ে নির্বাচন পরিচালনা করবে, তাদের নির্বাচনী ফলাফলে কোন স্বার্থ থাকতে পারেব না। সে ধরণের কিছু মানুষকে নিয়ে আমরা তাদের দায়িত্ব দিতে চাই যে, তারা যেন একটা ট্রানজিশন (ক্ষমতার পালাবদল) সম্পন্ন করেন। ট্রানজিশন হবে কর্তৃত্ববাদী সরকার থেকে একটা গণতান্ত্রিক সরকারে উত্তরণ। সেটার প্রক্রিয়াটি কী হবে? সেটা হচ্ছে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন।

নির্দলীয় সরকার কি দীর্ঘমেয়াদি হবে?
বিএনপি জোর দিচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের উপর এবং সেক্ষেত্রে দলটির কাছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিস্তারিত রূপরেখা না থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সেই সরকারকে কী কী করতে হবে তা নিয়ে দলের ভেতরে আলোচনা আছে। সেই তালিকাও বেশ লম্বা। যেমন - নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা, প্রশাসনকে ‘নিরপেক্ষ’ করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো, এমনকি বিচারবিভাগেও কিছু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে দলের নেতাদের পক্ষ থেকে।

বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলছেন, এসব বিষয়ে সংস্কার না হলে অবাধ নির্বাচন সম্ভব হবে না। এই নির্বাচনটি নির্বাচন কমিশন যেন নির্দলীয় সরকারের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে করতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। ভোটের পরিবেশ এমন করতে হবে যেন সকল দল, প্রার্থী এবং কর্মীরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারে। যখন ক্যান্সার হয়েছে শরীরে, তখন সেটা সারাতে তো সময় লাগবেই এবং সে সময়ও দিতে হবে।

এর আগে একাধিক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেসব সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাস। যদিও ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর। এবার বিএনপি নিরপেক্ষ কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে কথা বলছে, সেখানে সেই সরকারের মেয়াদ নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি দলটির তরফ থেকে। আবার একইসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেসব কাজের কথা বিএনপি তুলে ধরছে সেটার বাস্তবায়নও সময়সাপেক্ষ। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আলোচনা আছে যে, বিএনপি এখনই নির্বাচনে না গিয়ে নির্বাচনের আগে অন্তত এক থেকে দুই বছর মেয়াদি কোন একটা অন্তর্বর্তীকালীন ‘নিরপেক্ষ’ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যার উদ্দেশ্য হতে পারে এই সময়ের মধ্যে মামলার চাপ কমিয়ে দল গোছানো এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দেশের বাইরে থাকা নেতাদের দেশে ফেরার পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু বিএনপি কি আসলে সেটাই চায়? আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়েই বা দলের বক্তব্য কী?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলছেন, চাইলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ অল্প সময়েও তৈরি করা যায়। আমরা জানি যে অনেক সংস্কার করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে এসব সংস্কার করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তারপরে আমরা একটা নির্বাচন করবো, তারপরে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে। এটা কেউ বলতেই পারেন। আবার কেউ এটাও বলতে পারেন যে এটা কয়েকমাসেই করা সম্ভব। আসলে আমাদের কাছে এটাও এখন মূখ্য প্রশ্ন নয়। আমাদের মূখ্য প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রানজিশন।

মঈন খান গুরুত্ব দিচ্ছেন 'ক্ষমতার পালাবদলের' উপর। কিন্তু সেই পালাবদল যে সরকারের মাধ্যমে হবে সেটার ধরণ এবং মেয়াদ এখনো অস্পষ্ট। আর এখানেই বিএনপি’র দুর্বলতা দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন। তার মতে, জনগণের কাছে হাজির করার মতো স্পষ্ট কোন রূপরেখা যদি বিএনপি’র না থাকে তাহলে জনগণের কাছে তারা কী চায় সেটা পরিস্কার হয় না। তারা মনে করছে যে নির্দলীয় সরকার হওয়া উচিত, কিন্তু এটা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার কোন চিত্র জনগণের সামনে দিতে পারছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটা কিভাবে পরিচালিত হবে, মানুষের সেটা জানা দরকার এবং কেন মানুষ বিএনপিকে এ বিষয়ে সমর্থন দেবে সেটাও বিএনপিকে স্পষ্ট করতে হবে ।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, একদিকে নির্দলীয় কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি’র পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে সরকারের পতন ঘটিয়ে দাবি আদায়ের সক্ষমতা বিএনপি’র কতটা আছে তা নিয়েও সংশয় আছে। ফলে এই বিষয়গুলোর সুরাহা বিএনপি কিভাবে করবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।