| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক চাল রফতানিতে সিঙ্গাপুরের মতো ঢাকাও কি দিল্লির ছাড় পাবে?


চাল রফতানিতে সিঙ্গাপুরের মতো ঢাকাও কি দিল্লির ছাড় পাবে?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     31 August, 2023     01:56 PM    


ভারত সরকার দেশ থেকে সিদ্ধ চাল রফতানির ওপর গত মাসে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তা থেকে সিঙ্গাপুরকে আচমকা ছাড় দেওয়ার পর একই সুবিধা বাংলাদেশকেও দেয়া হবে কি না সেই জল্পনা জোরালো হচ্ছে। গত সপ্তাহেই বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী জয়পুরে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে তাঁর বৈঠকে ইতিমধ্যেই এই ছাড় দেয়ার অনুরোধ করেছেন।

ভারতের শীর্ষ চাল রফতানিকারকরাও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ তাদের জন্য বিরাট একটি বাজার এবং এই নিষেধাজ্ঞা থেকে বাংলাদেশ বা নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড় পেলে তারা খুবই খুশি হবেন। ভারতেও পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্কের বিবেচনায় একই ধরনের সুবিধা তাদেরকেও দেওয়া উচিত – বিশেষ করে যেহেতু আর মাসচারেকের মধ্যেও বাংলাদেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশ এবং তারা বিশ্বের যে সব দেশে চাল রফতানি করে থাকে তার প্রথম পাঁচটির মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

রফতানি পরিসংখ্যান বলছে, ভারত থেকে বাসমতী নয়, এমন চাল আমদানির ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশ বেনিন ও সেনেগাল এবং দক্ষিণ এশিয়ার নেপালের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। গত ২০ জুলাই ভারত বাসমতী নয়, এমন সব ধরনের সাদা চালের রফতানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর বিশ্বব্যাপী খাদ্য বাজারে রীতিমতো অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘও ভারতকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে।

ভারত অবশ্য বলছে, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতেই তাদের বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এদিকে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী বাংলাদেশেও নির্বাচন আসন্ন, সেখানেও চলতি মৌশুমে ফলন তেমন ভাল না-হওয়ায় সিদ্ধ চাল আমদানির চাহিদা আছে। এই পটভূমিতে সিঙ্গাপুরের পর একই ধরনের ছাড় বাংলাদেশকেও দেওয়া হয় কি না, দিল্লির সেই সিদ্ধান্তের দিকে পর্যবেক্ষকরা স্বাভাবিক কারণেই নজর রাখছেন।

যেভাবে সিঙ্গাপুরকে ছাড়
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার বেশি রাতে এক বিবৃতিতে জানায়, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ভারতের ‘অত‍্যন্ত নিবিড় স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কে’র কথা বিবেচনায় রেখে ওই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে চাল রফতানির নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। মাসদেড়েক আগে ভারত ওই নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর থেকেই সিঙ্গাপুর সরকার তা থেকে ছাড় চাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ রেখে চলছিল। সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাতেই যে অবশেষে ফল মিলেছে, ভারত সরকারের গত রাতের পদক্ষেপেই তা স্পষ্ট। কেন এই পদক্ষেপ, তা ব্যাখ্যা করে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানান, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, তা ছাড়া দুই দেশের মানুষে-মানুষে সংযোগ বা পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্টও খুব শক্তিশালী।

পৃথিবীর প্রায় চল্লিশটির মতো দেশ তাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ভারত থেকে চাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সিঙ্গাপুরও তার একটি। ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণও ৩০০০ কোটি ডলারের বেশি। সিঙ্গাপুরে জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও প্রধানত তামিল, তাদের খাদ্যাভ্যাসে সিদ্ধ চালের একটা বড় ভূমিকাও আছে। এই সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করেই ভারত সিঙ্গাপুরকে এই বিশেষ ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

২০২২ সালে ভারত যখন গম রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তখনও আরব বিশ্বের বন্ধু দেশ মিশরকে তা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। যদিও তখন সে কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়নি। এখন সিঙ্গাপুরকে যে সব যুক্তিতে ভারত এই বিশেষ সুবিধা দিয়েছে তার অনেকগুলোই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য – যে কারণে অনেকে মনে করছেন তাদেরও একই সুবিধা দিলে ভারতের কূটনৈতিক লাভ বই ক্ষতি নেই!

জয়পুরে বাণিজ্যমন্ত্রীদের বৈঠক
জি-টোয়েন্টি জোটের বর্তমান চেয়ার ভারত গত সপ্তাহেই জোটভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে। বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল বাংলাদেশও। ওই সম্মেলনের অবকাশে গত ২৩ অগাস্ট (বুধবার) ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ও তাঁর বাংলাদেশি কাউন্টারপার্ট টিপু মুন্সীর মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়, ভারত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের রফতানিকে মসৃণ করার জন্য যাতে একটি ‘প্রক্রিয়া’ প্রণয়ন করা হয়, টিপু মুন্সী মি গোয়েলের কাছে নেই অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারত সম্প্রতি পেঁয়াজ রফতানির ওপর যে বাড়তি চল্লিশ শতাংশ রফতানি শুল্ক বাসিয়েছে, সেটাও প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানান তিনি।

বস্তুত বাংলাদেশে বিভিন্ন কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারত যে ‘খেয়ালখুশিমতো’ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বা বাড়তি শুল্ক বসিয়ে থাকে, বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই তার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাঁর বিগত একটি ভারত সফরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত অনুযোগ করেছিলেন, দুম করে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বসানোর আগে ভারত যদি আগেভাগে তাদের জানিয়ে সেটা করে তাহলে অনেক সুবিধে হয়।

বিবিসি জানতে পেরেছে, জয়পুরের বৈঠকে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটিও তুলেছিলেন। বাংলাদেশকে এর আওতার বাইরে রাখা যায় কি না, তিনি সেটি বিবেচনা করতে মি গোয়েলকে অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের সেই অনুরোধে ভারত এখনও যেমন সায় দেয়নি, তেমনি আবার সেটি খারিজও করে দেয়া হয়নি। এর আগে চলতি অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি দিল্লিতে পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের বৈঠকেও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছিল ভারত। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে যেখানে আমরা বছরে প্রায় ১ কোটি টন সিদ্ধ চাল রফতানি করি, সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে পরিমাণটা কিন্তু তার দশ শতাংশও নয়। কাজেই সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে যত সহজে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া গেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ততটা সহজ না-ও হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

ভারতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া?
বাসমতী নয়, এমন সব ধরনের সাদা চাল বিদেশে রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতের চাল রফতানিকারকরা যে ক্ষুব্ধ ও হতাশ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা চাইছেন যত দ্রুত সম্ভব এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হোক।

দিল্লিতে রাইস ইন্ডিয়া এক্সপোর্টসের কর্ণধার তানিষ্ক আগরওয়াল বলছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে আমরা মনে করছি! ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম এই মরশুমে এমন কিছু বাড়েনি যে দুম করে রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার কোনও দরকার ছিল। তাঁর মতে এটা সরকারের ‘নি জার্ক রিঅ্যাকশন’ ছাড়া আর কিছুই নয়।

পুনের চাল রফতানিকারক গঙ্গাধর কালবান্দেও বলছিলেন, “জুলাইয়ে সরকার নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর থেকেই আমাদের কাছে এনকোয়ারি আসা হু হু করে কমতে শুরু করেছে। নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে রফতানিকারকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন - তেমনি সরকারের কোষাগারেও বৈদেশিক মুদ্রা অনেক কম আসছে।

ভারতের চাল রফতানিকারকরা তাই প্রায় একবাক্যে বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার। আর যেহেতু বাংলাদেশ ও নেপাল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর অন্যতম – তাই ওই দুই দেশকে সবার আগে ছাড় দেয়া উচিত বলেও তাদের অভিমত। ভারতে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞরা আবার অনেকেই মনে করছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত না-হলে সরকারের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেডের অধ্যাপক প্রালোক গুপ্তা বলছিলেন, আমার ধারণা এটা হতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে কোন দেশকে ছাড় দেওয়া হতে পারে, সেটা চলতি মরশুমে ধানের ফলন কেমন হয় তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে।

দিল্লিতে বর্ষীয়ান কূটনৈতিক সংবাদদাতা গৌতম লাহিড়ী বলছিলেন, ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের জন্য সিঙ্গাপুরকে যদি ছাড় দেওয়া হয় তাহলে তো বলতে হবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্ট্র্যাটেজিকেরও বাড়তি কিছু – যেটাকে দুই দেশ বলে থাকে সোনালি অধ্যায়! বাংলাদেশ শাসক দল ও সরকারকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট আশ্বাস দেওয়ার পর চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা থেকে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে আর দেরি করা উচিত নয় বলেই মি লাহিড়ীর অভিমত। বিশেষত বাংলাদেশেও ভোট আসন্ন। সেখানে চালের দাম আকাশ ছুঁলে যে অস্থিরতা তৈরি হবে, সেটা ভারতের স্বার্থেরও পরিপন্থী হবে বলে আমার বিশ্বাস।