| |
               

মূল পাতা সাহিত্য ফিচার মৌলভীবাজারে ৫৪৭ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ


মৌলভীবাজারে ৫৪৭ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ


এহসান বিন মুজাহির     02 June, 2023     06:37 PM    


প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর মসজিদগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামি ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এমনই একটি প্রাচীন মসজিদ হলো গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার  মসজিদ। অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ মসজিদটি মৌলভীবাজার জেলা সদর উপজেলার ১১ নং মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর এলাকায় অবস্থিত। মসজিদটি ৫৪৭ বছর পূর্বে সুলতান শামস উদ্দিন ইউছুফ শাহ এর শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।অপূর্ব নকশা কারুকার্য সমৃদ্ধ মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হয়ে আজও বিদ্যমান।

শুক্রবার (২ জুুন) বিকেলে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর গ্রামের পাহাড়ি স্থানে অবস্থিত মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি বড় দরজা এবং ছয়টি ছোট দরজা। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম পাশের দেয়ালে রয়েছে অতি প্রাচীন কালো পাথরে লেখা আরবি শিলালিপি। চুরি ঠেকাতে এবং সংরক্ষণ রাখতে এটাকে লোহার গ্রিলে বেষ্টন করে রাখা হয়েছে।

মসজিদের ভেতরে পূর্ব স্তম্ভে বাঘের পায়ের ছাপ এখনো বিদ্যমান। মসজিদটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৪ হাত করে। মসজিদের চারপাশের ইটের গাঁথুনি ও দেয়ালগুলো অনেক পুরু। মসজিদের মেহরাবটি পুরোটাই দেয়ালের ভেতরে পড়েছে। মসজিদের উপরে রয়েছে ১৮ ফুট উঁচু একটি গম্বুজ এবং পরবর্তীতে মসজিদের সাথে সংযুক্ত করা বারান্দায় রয়েছে ছোট আরও তিনটি দৃষ্টিনন্দন গম্বুজ। প্রত্যেক গম্বুজের ভেতরে গোল অংশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। মূল মসজিদের গম্বুজের উপরের অংশ বেশ বড়, যা এখন সাদা টালিযুক্ত। দূর থেকেও মসজিদের দেয়ালের সাদা রঙ জ্বলজ্বল করে। মসজিদের মেঝে এবং বারান্দাও টালিযুক্ত।

মসজিদের ভেতরের বিভিন্ন অংশে চোখে পড়ে নানা কারুকার্য। চুন, সুরকি, ইটের গাঁথুনি আর ভেতর ও বাইরের অপরূপ কারুকার্য মসজিদটির সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মসজিদের ওপরে গোল গম্বুজের দেয়ালে আরবিতে লেখা রয়েছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। পশ্চিম দেয়ালে একটি অতি প্রাচীন কালো পাথরের লিপি রয়েছে। এলাকার মুসল্লিরা এখানে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত এবং শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করেন। মসজিদের সাথে পরবর্তীতে একটি বারান্দা সংযুক্ত করা হয়েছে। এখানে মহিলারা নামাজ পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ পাঠ করেন। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি ছোট্ট পুকুর। এখানে কয়েকটি গজার মাছকে খেলা করতে দেখা যায়। মসজিদের সীমার ভেতরে রয়েছে বিশাল একটি ঈদগাহ মাঠ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জামাতে এই ঈদগাহ মাঠে হাজার হাজার মুসল্লিরা অংশ নেন। মসজিদের সীমানার ভেতরের পূর্ব পাশে রয়েছে কবরস্থান। পূর্ব এবং দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছোট্ট দুইটি গেইট। দূর থেকে মসজিদ ও কবরস্থানের বাউন্ডারির সাদা রঙ জ্বলজ্বল করে। চুন, সুরকি, ইটের গাঁথুনি আর ভেতর ও বাইরের অপরূপ কারুকার্য মসজিদটির সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা করিম মিয়া জানান,খোজা মসজিদে সংরক্ষিত শিলালিপির একটি খণ্ড সুলতান বরবক শাহের পুত্র সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে হাজী আমীরের নাতি ও তৎকালীন মন্ত্রী মজলিস আলম এটি নির্মাণ করেন। সিলেটের হযরত শাহজালাল রহ. মসজিদ ও খোজা মসজিদের শিলালিপিতে উল্লেখিত মজলিসে আলম একই ব্যক্তি। মসজিদ দুটি চার বছরের ব্যবধানে নির্মিত হয়েছিল। তবে মসজিদের পূর্ব পাশে দরজার সামনে টাইলসের ওপরে লেখা রয়েছে মসজিদের স্থাপিতকাল ৮৭১ হিজরি, ১৪৭৬ ইংরেজি এবং ৮৭৭ বাংলা এবং স্থাপিতকারীর নাম লেখা রয়েছে সুলতান শামস্ উদ্দিন ইউছুফ শাহ।

খোজার মসজিদের নামকরণ নিয়ে অনেক কথাই শুনা যায়। এবিষয়ে জানতে চাইলে এলাকার বাসিন্দা ফটিক মিয়া বলেন, খোজা মসজিদের নামকরণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। অনেকে অনেক ধরণের তথ্য দেন। তবে সবচেয়ে প্রচলিত যে কথা, সেটা হলো বাংলার সুবেদার মানসিংহের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে পলায়নের সময় পাঠান বীর খাজা ওসমান মসজিদটির এ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই থেকে খাজা নামের অপভ্রংশ খোজা থেকে এর নামকরণ।

খোজার মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ এখলাসুর রহমান বলেন, স্থানীয় প্রবীণ লোকজনের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, মসজিদটি ছোট একটি পাহাড়ের উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। যখন মসজিদ নির্মিত হয় তখন এই এলাকাটি ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। বিচরণ ছিল বাঘসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর। তাদের ধারণা সম্ভবত সেই সময় একটি বাঘ মসজিদের রুক্ষ দেয়ালে আঁচড় দিয়েছিল। সেই চিহ্ন মসজিদের দেয়ালে এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তিনি বলেন, দেয়ালের ওপরে আরবি লিপি রয়েছে। এই শিলালিপিতে কি লেখা রয়েছে কেউ স্পষ্ট বলতে পারেননি। অনেক বড় বড় আলেমরা এসে এই শিলালিপি দেখেছেন, পড়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এতে কি লেখা তাদের পক্ষে বলা সম্ভব হয়নি। 

ঐতিহাসিক মসজিদ দেখতে আসা শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, সাড়ে পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক এই মসজিদটি আমাদের মৌলভীবাজার জেলার গর্ব।  ইউনেস্কোতে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণে সরকার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ঐতিহাসিক খোজার মসজিদের ইমাম মাওলানা আজিজুর রহমান খান রাজু বলেন, অনন্য নির্মাণশৈলীর এ মসজিদটি প্রায় ছয় শতাব্দি ধরে মুসলিম ঐতিহ্যের প্রাচীন ও অন্যতম নির্দশনের পরিচয় বহন করে আসছে। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমআর নামাজে সহস্রাধিক মুসল্লি অংশ নিয়ে থাকেন। মূল মসজিদে মুসল্লিদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পরবর্তীতে মূল মসজিদের সাথে মসজিদের পূর্ব পাশে বারান্দা সংযুক্ত করা হয় এবং উত্তর পাশে মহিলাদের নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য আরেকটি বারান্দা সংযুক্ত করা হয়। জুমআর দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে  প্রচুর মুসল্লিরা আসেন।  ঐতিহাসিক এ খোজা মসজিদটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই নানা শ্রেণি পেশার মানুষের আগমন ঘটে। দর্শনার্থীদের থাকার সুব্যবস্থা ও সংরক্ষণসহ সরকারিভাবে মসজিদের আরও উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে পুরাতন কীর্তি হিসেবে এটি হতে পারে মৌলভীবাজারে জেলার অন্যতম প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্য ঐতিহ্যের নির্দশন।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, ঐতিহাসিক স্থাপত্য শিল্প, পুরকীর্তি ও প্রত্নতত্ত্বের সুষ্ঠু সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।