| |
               

মূল পাতা ইসলাম শাওয়ালের ৬ রোযার গুরুত্ব ও ফযীলত


শাওয়ালের ৬ রোযার গুরুত্ব ও ফযীলত


রহমত নিউজ ডেস্ক     24 April, 2023     02:07 PM    


নবজীবনটা যাতে ভোগের মোহকে মিটিয়ে দিয়ে ত্যাগের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়, মনুষ্যসমাজ যাতে আদর্শিক মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, সে জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলমানের ওপর মাহে রমযানের রোযাকে ফরজ করেছেন। তবে রোযার মহৎ শিক্ষাটা যেন শুধু রমযানের একটি মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বছর ভরে জীবনজুড়ে এর অনুশীলন হতে থাকে সেজন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বছরের বার মাসের বিভিন্ন সময়ে নফল রোযা নিজে রেখেছেন এবং উম্মতকে রাখতে উৎসাহিত করেছেন। নফল রোযাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা। সাধারণ মুসলমান এই ছয় রোযাকে সাক্ষী রোযা হিসেবে জানলেও পবিত্র কোরআন, হাদীস বা ধর্মীয় গ্রন্থাদিতে এই নামটি খুঁজে পাওয়া যায় না।

শাওয়াল মাসের ৬ রোযার ফযীলত : রমযান মাসের পরের মাস অর্থাৎ হিজরি সনের দশম মাস হলো শাওয়াল মাস। এ মাসের প্রথম দিনে মুসলিম উম্মার সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসব, ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। উৎসব আনন্দে মুসলমানগণ যাতে রমজানের মহৎ শিক্ষাটা ভুলে না যায়, হয় তো সে জন্যই রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এ মাসে ছয়টি নফল রোযা রাখতে উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসের সব ফরজ রোযাগুলো রাখল অতঃপর শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন সারাবছর ধরেই রোযা রাখল। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬৪)

আলোচ্য হাদিসে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো- শুধু শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখলেই এক বছরের নফল রোযার সওয়াব পাওয়া যাবে তেমনটি নয়। আবার শুধু মহিমাম্বিত রমজানে পুরো একমাস রোযা রাখলেও এক বছরের নফল রোযার সওয়াব দেওয়া হবে সে কথাও কোথাও বলা হয়নি। বরং পুরো রমযান মাস রোযা রাখার পরে শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোযা রাখলে তবেই পূর্ণ এক বছর নফল রোযা রাখার সওয়াব লাভ করা যাবে সে কথাই হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন।

বস্তুত হাদিসে পবিত্র কোরআনেরই একটি আয়াতের বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ কোন নেক আমল করবে তাকে তার দশ গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। ’ (সুরা আল-আনআম: ১৬০) সুতরাং রমজানের এক মাসের ১০ গুণ হলো দশ মাস আর শাওয়াল মাসের ছয়দিনের দশগুণ হলো ৬০ দিন অর্থাৎ দুইমাস। অর্থাৎ পূর্ণ এক বছরের নফল রোযার সওয়াব লাভের জন্য রমযানের রোযা রাখার পরে শাওয়াল মাসের ছয় রোযা রাখার শর্ত থাকলেও যদি কেউ কোনো কারণে রমযানের পূর্ণমাস রাখতে না পেরে থাকেন, তাহলে শাওয়াল মাসের ছয় রোযা রাখা যাবে না তেমনটি নয়। সে ক্ষেত্রে পূর্ণ এক বছরের নফল রোযার সওয়াব না পেলেও নফল রোযা পালনের সীমাহীন নেকি তিনি পাবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কীভাবে রাখবেন ৬ রোযা : হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  শাওয়াল মাসের ভেতর ছয় রোযা রাখার কথা বলেছেন। মাসের প্রথম দিকে, মধ্যভাগে না শেষাংশে সে কথা হাদিসে উল্লেখ নেই। আবার ছয়টি রোযা একসঙ্গে লাগাতার রাখতে হবে, না-কি বিরতি দিয়ে দিয়ে রাখতে হবে, সে কথারও কোনো উল্লেখ নেই। তাই বিজ্ঞ ফকীহ ও আলিমগণের অভিমত হল, যেহেতু শাওয়াল মাসের প্রথম দিন মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসব এবং ওই দিনে রোযা রাখা হারাম, সেহেতু ঈদুল ফিতরের দিনটি বাদ দিয়ে মাসের যে কোনো ছয়দিনে রোযা রাখলেই উল্লিখিত সওয়াব লাভ করা যাবে। এই আরবি শাওয়াল মাসের অর্থাৎ প্রথমদিকে, মাঝামাঝি দিনগুলোতে অথবা শেষদিকে, আবার একাধারে ছয়দিন অথবা একদিন রোযা রেখে তারপর একদিন বা দু’দিন বিরতি দিয়ে আবার একদিন যে কোনোভাবে রোযা রাখা যাবে। শাওয়াল মাসের মধ্যে ছয়টি রোযা রাখলেই হাদিসে বর্ণিত সওয়াব পাওয়া যাবে, ইনশাআল্লাহ।

শাওয়াল মাসের ৬ রোযার জরুরি কিছু প্রশ্নোত্তর
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাওয়াল মাসে ৬টি নফল রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। শাওয়াল মাসের ৬ রোযা প্রসঙ্গে অনেকেরই বিশেষ ৯টি প্রশ্ন আছে। যেগুলোর উত্তর অনেকেই জানেন না। তাদের জন্য প্রশ্নগুলোর উত্তর তুলে ধরা হলো-

শাওয়াল মাসে ৬টি নফল রোযা রাখালে কী উপকার হবে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসের রোযা রাখল অতঃপর শাওয়াল মাসে (পুরো শাওয়াল মাসের মধ্যে যে কোনো সময়) ৬টি রোযা রাখল; ওই ব্যক্তি সারা বছর রোযা রাখার সমান সাওয়াব পাবে।’ (মুসলিম)

কেন সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব পাবে?
ইমাম নববি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শাওয়ালের ৬ রোযার ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, রমযান মাস ২৯/৩০ হয়ে থাকে। যদি ৩০ ধরা হয় আর শাওয়ালের ৬ রোযা ধরা হয় তবে রোযা হয় ৩৬টি। আর আল্লাহ তাআলার ঘোষণা- ‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজ করে, আল্লাহ তাআলা তাকে ১০গুণ বাড়িয়ে দেন।’ সে হিসেবে ৩৬টি রোযায় ১০ গুণ সাওয়াব পেলে ফলাফল হয় ৩৬০ দিন তথা পুরো বছর রোযা রাখার সাওয়াব। আর এভাবেই সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব পায় রমজানের রোযা রাখার পর শাওয়ালের ৬ রোযা পালনকারী রোযাদার।‘

শাওয়ালের রোযা কি রমজানের রোযা কবুল হওয়ার প্রমাণ?
রমজানের রোযা কবুল হওয়ার একটি আলামত হলো- রমজানের রোযা পালনকারী ব্যক্তির শাওয়ালের রোযা রাখা। যদি কারো রমজানের রোযা কবুল হয় তবে আল্লাহ তাআলা ওই বান্দাকে শাওয়ালের ৬ রোযা রাখার তাওফিক দান করেন। কারণ কোনো আমল কবুল হয়েছে কিনা তার আলামত হচ্ছে- আগের নেক আমলের ধারা পরবর্তীতে ধরে রাখা। যেমনিভাবে রমজানের রোযা পালনকারী রমযান পরবর্তী শাওয়াল মাসে আবারও রোযা পালনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে। আর তা হয়ে থাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে।

শাওয়ালের রোযা কি একটানা রাখতে হবে?
শাওয়ালের রোযা কি একটানা রাখতে হবে নাকি ভেঙে ভেঙে রাখা যাবে। এর সঙ্গে রোযা হওয়া-না হওয়ার বিষয় জড়িত আছে কিনা। এর উত্তর হলো- ‘শাওয়ালের ৬টি রোযা একটানা না রেখে ভেঙে ভেঙে রাখলেও আদায় হয়ে যাবে। কেউ যদি একটানা রোযা রাখে তাতেও আদায় হয়ে যাবে।’ কারণ হাদিসের কোনো বর্ণনায় শাওয়ালের ৬ রোযা একসঙ্গে রাখার ব্যাপারে কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি।

শাওয়ালের রোযা রাখার সহজ উপায় কী?
সাপ্তাহিক ও মাসিক (আইয়্যামে বিজ) রোযার সঙ্গে মিল রেখে সহজেই শাওয়ালের রোযাগুলো রাখা যায়। আর এতে বেশি কষ্টও হয় না। কারণ সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখলেই পুরো মাসে সহজে ৬টি রোযা রাখা সহজ হয়ে যায়। আবার আইয়্যামে বিজের ৩টি রোযা একসঙ্গে রেখে অন্য সময়ে ৩টি রোযা রাখার মাধ্যমেও ৬ রোযা রাখা যায়। তবে কেউ যদি একটানা ৬টি রোযা রাখে তাতেও কোনো সমস্যা নেই।

শাওয়ালের রোযার নিয়ত কখন করতে হবে?
শাওয়ালের ৬ রোযার নিয়ত সন্ধ্যায় কিংবা রাতেই করতে হবে। পরের দিন সূর্য ওঠার পর করলে হবে না। পবিত্র রমযান মাসে ভোর রাতে ওঠার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। সে সময় সাহরি খেয়ে রমজানের রোযা পালনকারীরা রোযার নিয়ত করে থাকেন। শাওয়ালের ৬ রোযার ক্ষেত্রে কারো যদি ঘুম থেকে ওঠার পর স্মরণ হয় বা মনে করে যে, রাতে তো খাবার খাওয়া হয় নাই; সুতরাং শাওয়ালের ৬ রোযার নিয়ত করে ফেলি। তবে কি রোযা হবে? ‘না’, এমনটি করলে রোযা হবে না। কারণ শাওয়ালের ৬ রোযাসহ নফল রোযা রাখার ক্ষেত্রে নিয়ত করতে হবে রাত থেকে। কেউ যদি সন্ধ্যা রাতে নিয়ত করে ফেলে যে, আমি আগামীকাল রোজা রাখবো আর দিনের বেলা রোযা পালন করে তবে ওই ব্যক্তির রোযা হয়ে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যা বা রাতে নিয়ত না করে সূর্য ওঠার পর ঘুম থেকে ওঠে রোযার নিয়ত করলে রোযা হবে না।

রমজানের কাজা বা ভাঙতি রোযা থাকলে আগে কোন রোযা রাখতে হবে?
হ্যাঁ, অবশ্যই আগে রমজানের ভাঙতি/কাজা রোযা রাখতে হবে। তারপর শাওয়ালের ৬ রোযা রাখবে। কারণ শাওয়ালের রোযার সাওয়াব ঘোষিত হয়েছে তাদের জন্য যারা রমজানের রোযা পূর্ণ করেছে। কেননা হাদিসে এমনই নির্দেশনা ও শর্ত দেওয়া হয়েছে। আর রমজানের রোযা পালনকারী ব্যক্তি শাওয়ালের ৬ রাখলেই কেবল ৩৬ দিন পূর্ণ হবে। আর তা ৩৬০ দিনের সাওয়াব হিসেবে পরিগণিত হবে। সুতরাং যদি কারো অসুস্থতা বা সফরের কারণে ভাঙতি রোযা থাকে। আর মা-বোনদের নিয়মিত অসুস্থতার কারণে ভাঙতি রোযা থাকে তবে তা আগে আদায় করতে হবে। তারপর শাওয়ালের ৬ রোযা রাখতে হবে।

সাপ্তাহিক ও আইয়্যামে বিজের রোযার পালনের সময় শাওয়ালের ৬ রোযার নিয়ত করলে হবে কি?
সাপ্তাহিক সোম ও বৃহস্পতিবার এবং আইয়্যামে বিজ তথা চন্দ্র মাসের ১৩-১৪-১৫ তারিখ রোযা রাখা সুন্নাত। এখন কেউ যদি এ রোযাগুলো রাখার সময় শাওয়ালের ৬ রোযার নিয়ত করে তবে শাওয়ালের রোযা আদায় হবে কি? হ্যাঁ, সাপ্তাহিক ও মাসিক (চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) রোযা রাখার সময় কেউ যদি শাওয়ালের ৬ রাখার নিয়ত করে তবে তার শাওয়ালের রোযা আদায় হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ। তবে যে কোনো একটির নিয়ত করতে হবে। হয় সাপ্তাহিক/মাসিক রোযার নিয়ত নতুবা শাওয়ালের ৬ রোযার।

শাওয়াল মাসে ৬ রোযা না রেখে পরের কোনো সময় এ রোযা রাখলে হাদিসে ঘোষিত সাওয়াব পাওয়া যাবে কি?
‘না’, শাওয়াল মাস চলে যাওয়ার পর (অন্য মাসে) ৬ রোযা (কাজা) রাখলে হাদিসে ঘোষিত ৬ রোযায় সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব পাওয়া যাবে না। কারণ ৬টি রোযা রমজানের রোযা পালনকারীর জন্য শাওয়াল মাসের মধ্যে রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছে। যারা শর্ত পূরণ করতে পারবে, তারাই বছরজুড়ে রোযা রাখার সাওয়াব পাবে। এ সাওয়াব শাওয়াল মাসে রোযা রাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

সুতরাং রমজানের সব রোযা পালনকারী মুমিন মুসলমানের উচিত বছরজুড়ে রোযা রাখার সাওয়াব পেতে শাওয়াল মাসে ৬টি রোযা একটানা কিংবা থেমে থেমে আদায় করা। আর তাতেই মিলবে বছরজুড়ে রোযা রাখার সাওয়াব। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শাওয়ালের ৬ রোযা যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।