মুফতি এনায়েতুল্লাহ 27 March, 2023 02:33 AM
আজ (২৮ মার্চ) মঙ্গলবার রাত ১.২০ মিনিটে রাজধানীর সায়েদাবাদস্থ আল কারিম হাসপাতালে বার্ধক্যজনীত অসুস্থতায় আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর প্রবীণ উস্তাদ, লেখক গবেষক, ‘বাবা হুজুর’ খ্যাত মাওলানা মুমতাজুল করিম ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি ২ ছেলে এবং ২ মেয়ের জনক।বাবা হুজুরের বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদু্ল হাসান মোমতাজী জানান, জানাযা নামাজ ২৮ মার্চ বাদ আসর হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হবে।
আমাদের পৃথিবী এমনই একটি জগত, যেখানে আলো আর আঁধার একসঙ্গে থাকে না। পৃথিবীর পথ-পরিক্রমায় সূর্যের আলো আড়াল হয় বটে, কিন্তু সেই ঘন আঁধার কেটেও যায়। সূর্যের আলো সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে। অন্ধকার ঠেলে দেয় অনেক দূর। আলোয় আলোয় ভরাট হয় পৃথিবী। এ হচ্ছে প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম। আলো-আঁধারের পুরো নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীনের। তবে দুনিয়াবাসীকে আলোকিত করতে এমন কিছু মানুষের অবদান থাকে, যারা যুগের পর যুগ নিরলস শ্রম দিয়ে সমাজকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এমনই এক ব্যক্তিত্ব হলেন- ‘বাবা হুজুর’খ্যাত মাওলানা মুমতাজুল কারিম। ইসলামের জন্য নিবেদিত এই আলেমের সফলতার মূলমন্ত্র হলো- স্বচ্ছতা, সততা, নির্ভীক মনোভাব ও দ্বীনের প্রতি দরদ। তিনি বিশ্বাস করেন, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাময় এই পৃথিবীতে টিকে থেকে অবদান রাখতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা। মাওলানা মুমতাজুল কারিম ১৯৪২ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ থানার ডুলিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
কথা ও কাজে মিল রেখে জীবন পরিচালনায় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে তার ছাত্রদের অভিমত হলো- তিনি সাদাসিধে আল্লাহওয়ালা মানুষ। হাটহাজারী মাদরাসার এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ‘সন্ধ্যার পর রাস্তায় পেলেই হুজুর বলতেন, সূরা ওয়াকিয়া শোনাও, ফজরের পর দেখা হলে বলতেন সূরা ইয়াসিন শোনাও। অন্য সময় বিভিন্ন আয়াত-হাদিস শোনাতে বলতেন।’ আরেকজন খুব আফসোস করে বলেন, ‘দ্বীনের প্রতি তার দরদ অপরিসীম। একদিন নামাজ পড়ে হাটহাজারী মাদরাসার কাদিম মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় একটু ওপর থেকে জুতা মাটিতে ফেলেছিলাম, আওয়াজ হলো। হুজুর কাছে ডেকে শাসন করে এমনটা করতে নিষেধ করলেন। এর পর থেকে এমন ভুল আর হয়নি।’
বাংলাদেশের প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় ইসলামী সম্মেলনগুলোতে তিনি আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত হতেন। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তার আলোচনা শোনার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করতো। মাওলানা মুমতাজুল কারিম নিজ এলাকার বিখ্যাত বটগ্রাম হামিদিয়া মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর ফেনী শর্শদি মাদরাসায় কিছুদিন পড়াশোনা করে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। পরে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা থেকে সুনাম ও কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান গমন করেন। পাকিস্তানের বিখ্যাত মাদরাসা জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর থেকে তাফসির ও আদব (আরবি সাহিত্য) বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ময়মনসিংহের কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। তবে বেশিদিন সেখানে ছিলেন না। ওই বছরই (১৯৬৫) বরিশালের ঐতিহ্যবাহী চরমোনাই মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন এবং মুসলিম শরিফের দরস দেওয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকা আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদরাসায় সাত বছর মুহাদ্দিস হিসেবে খেদমত করে চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োগ পান। পটিয়া মাদরাসায় তিনি টানা সাত বছর সুনামের সঙ্গে হাদিসের দরস দেন। এ সময় পটিয়া থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক আত তাওহীদ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জামিয়া হোসাইনিয়ার প্রতিষ্ঠাও তিনি।
১৯৮৪ সালে দেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে নিয়োগ পান। হাটহাজারী মাদরাসায় অত্যন্ত সুনাম-সুখ্যাতির সঙ্গে হাদিসের দরস দিতে থাকেন। হাটহাজারী মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার অপরিসীম দরদ, ছাত্রগড়ার প্রতি তার মেহনত থেকে ছাত্ররা তাকে ‘বাবা হুজুর’ বলে সম্বোধন করতে থাকে। তিনিও দেশব্যাপী ‘বাবা হুজুর’ নামে পরিচিতি পান। একজন শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কী আছে? ১৯৮৪ সাল থেকে টানা ৩৫ বছর (২০১৯ পর্যন্ত) তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় হাদিসের দরস দিয়েছেন। এখন অসুস্থতার জন্য দরস দিতে না পারলেও উস্তাদ হিসেবে তার নাম রয়েছে। হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ফারেগ হওয়া আলেমরা দেশ-বিদেশে বহুবিধ খেদমতে আছেন। তাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার খবর নেওয়াসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ, উদ্ভুত সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার এই পাষাণ সময়ে এমন গুণ বিরলই বটে।
কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। চরমোনাই মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের কিছুদিনের মধ্যেই মরহুম চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক রহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৯১৫-১৯৭৭) মাওলানা মুমতাজুল কারিমকে অত্যাধিক স্নেহ ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করে মেয়ে সাইয়্যেদা হুরুননেছা বেগমকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। দীর্ঘ ৩০ বছর সংসার জীবন শেষে বাবা হুজুরের প্রিয়তমা স্ত্রী ১৯৯৫ সাল ৯ মে (হজের দিন) ইন্তেকাল করেন। পরে ১৯৯৬ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক বাবা হুজুর। তার বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান মুমতাজী দেশবিখ্যাত আলেম। তিনি তেজগাঁও রহিম মেটাল জামে মসজিদের খতিব, ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুওয়ত মুভমেন্ট বাংলাদেশের আমির ও ইসলামিক কালচারাল ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সদা সুন্নতের ওপর আমলকারী বিশিষ্ট বুজুর্গের আমল-আখলাকের কথা সর্বজনবিদিত। তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। এই অবস্থায়ও কেউ তাকে দেখতে গেলে হাদিয়া দেওয়ার কথা ভুলেন না। তিনি সুন্নতের খেলাফ কোনো কিছু দেখলে খুব রাগ হন। দুনিয়ার বুকে আমরা অনেক আলেম-বুজুর্গ, পীর-মাশায়েখ ও জ্ঞানী-গুণীর সাক্ষাৎ পাই। কিন্তু কথা ও কাজে মিল রেখে জীবন পরিচালনা করেছেন এমন ব্যক্তির সাক্ষাৎ সত্যিই দূর্লভ। মাওলানা মুমতাজুল কারিম বাবা হুজুর এমনই এক ব্যক্তিত্ব। ইসলামের প্রচার-প্রসার, কোরআনের তাফসির, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদসহ নানা দ্বীনি কাজে তিনি দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়িয়েছেন। অংশ নিয়েছেন সভা-সমিতি, ওয়াজ মাহফিল, জনসভা ও ইসলামি সম্মেলনে। একাধিক দেশও ভ্রমণ করেছেন। তন্মধ্যে তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, চীন, হংকং, কুয়েত, কাতার, বাহারাইন, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ভারত অন্যতম।
৮০ বছর বয়সী প্রবীণ এই আলেম অত্যন্ত যুগ সচেতন। শারিরীকভাবে তিনি অসুস্থ হলেও উম্মাহর চিন্তায় সদা ব্যাকুল ছিলেন। উম্মাহর কল্যাণে তার চিন্তার বর্হিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন বক্তব্যে। ২০১৭ সালের দিকে এখনকার মতো হাতে হাতে স্মার্টফোন সহজলভ্য হয়নি। তখনই স্মার্টফোনের ভয়াবহতা ও ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার লক্ষে এক মজলিসের বয়ানে বলেন, ‘স্মার্টফোনকে সময় না দিয়ে আল্লাহকে সময় দাও। বেশি বেশি কোরআন পড়ো। কোরআনে কারিমে সহিহ-শুদ্ধভাবে পড়া সব মানুষের জন্য ফরজ। তাই কোরআন মাজিদ শিখতে হবে। কোরআন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবেন। যারা কোরআন পড়তে পারেন, তারা বেশি বেশি কোরআন খতম করবেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের মধ্যে এতো বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন যে, তার পা মোবারক ফুলে যেতো। তিনি রাসুল হয়ে এতো বেশি কোরআন পড়তেন, আমাদের তো আরো বেশি পড়া দরকার। সুতরাং আমাদেরকে বেশি বেশি কোরআন পড়তে হবে। অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে।’
শুধু হাদিসের খেদমত ও ওয়াজ মাহফিল নয় লেখালেখিতেও মাওলানা মুমতাজুল কারিমের অবদান রয়েছে। সুলুক ও তাসাউফের মেহনতও তিনি করেছেন। হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারী তৈয়ব রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট বায়াত হন। পরবর্তীতে পীরে কামেল মাওলানা মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান এলাহাবাদী (বখশিবাজারী) তাকে চিঠির মাধ্যমে চার তরিকায় খেলাফত প্রদান এবং বায়াত করার অনুমতি দেন। এছাড়া দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামের শায়খুল হাদিস সন্দ্বীপের পীর সাহেব হজরত মাওলানা এহসানুল হক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে লিখিতভাবে খেলাফত দেন এবং খানকায়ে এহসানিয়া প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। ২০১৭ সালে মাহবুবুল উলামা হজরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদিও তাকে খেলাফত প্রদান করেন। বাবা হুজুর মালয়েশিয়ার হলুলাংগাত মিফতাহুল উলুম মাদরাসা মিলনায়তনে আয়োজিত শায়খ নকশবন্দীর ইসলাহি মুলতাকায় যোগ দিয়ে ১০ মিনিটের মতো আলোচনা করেন। তার আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে পীর নকশবন্দী তাকে খেলাফত দেন।
তার রচিত গ্রন্থাবলীর অন্যতম হলো- আরবি বোখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাদয়ুল কারি ইলা দিরাসাতিল বোখারি, বোখারি শরিফের উর্দূ ব্যাখ্যাগ্রন্থ হাবিবুল বারী শরহিল বোখারি, আরবি কাওয়ায়েদে ফিকহিল হানাফি, তারিখুত তাফসির, কোরআন-হাদিসের অমূল্য রত্ন, পরকালে মুক্তি কিসে (অনুবাদ), উলুমুল কোরআন, এসো কোরআনের অর্থ শিখি, আকিদায়ে খতমে নবুওয়ত, রায়বেন্ডের দশদিন (অনুবাদ) ও আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তা। এছাড়া বিভিন্ন মাসিক পত্রিকা, স্মরণিকা ও স্মারকগ্রন্থে তার অনেক লেখা প্রকাশ পেয়েছে।
মাওলানা মুমতাজুল কারিম বাবা হুজুরের শিক্ষকদের অন্যতম হলেন- বাংলাদেশের মীর সাহেব হুজুরখ্যাত শায়খুল উলুম ওয়াল মানাতিক, রঈসুল মুহাদ্দিসিন আল্লামা আমীর হোসাইন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, আল্লামা আনওয়ারুল আজীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, শায়খুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলাম শর্শদীর হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, পাকিস্তানের শায়খুত তাফসির ওয়াল ফুনুন আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, শায়খুল হাদিস আল্লামা মুহাম্মদ সরফরাজ খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, উস্তাজুল কুল, শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা রাসূল খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও শায়খুল ফালসাফা মাওলানা গোলাম গাওছ হাজরাভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ।
বাবা হুজুর বাংলদেশের সদর সাহেব হুজুরখ্যাত মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির সান্নিধ্যও পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালের দিকে তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় গেলে সদর সাহেব হুজুর তাকে সাথে করে নিয়ে পুরো মাদরাসা ঘুরিয়ে দেখান এবং ছাত্রদের দরস দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সমকালীন সময়ে বাংলাদেশের বড় বড় আলেমদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন। তিনি নিবিড়ভাবে যাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন- পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজিজুল হক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মোহাদ্দিস সাহেব হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
মাওলানা মুমতাজুল কারিম বাবা হুজুর একজন আশেকে কোরআন ও আশেকে কোরআনে হাফেজ। তার দুই ছেলেই হাফেজে কোরআন। সামাজিক মানুষ হিসেবে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সীমাহীন পরোপকারী, লেনদেনে অসম্ভব ধরনের স্বচ্ছতা তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি কাউকে কোনো বিষয়ের ওয়াদা দিলে তা পূরণ করতেন। এ জন্য তাকে শতভাগ ওয়াদা পূরণকারী ব্যক্তিত্ব বলা হয়। ওয়াদা খেলাফকারীদের তিনি ভীষণ অপছন্দ করেন। দেশের আনাচে-কানাচে তার যেমন অনেক ছাত্র রয়েছে, তেমনি সরকারি উচ্চমহলে বাবা হুজুরের অনেক ভক্ত রয়েছে। তারা বাবা হুজুরকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন, সম্মান করেন। স্বাভাবিক গড়নের ফর্সা চেহারার অধিকারী বাবা হুজুর খুব কম আহার করেন। তবে লাউ, ছোট মাছ তার পছন্দের খাবার। এছাড়া খুরমা ও কাজুবাদাম খেতে তিনি ভালোবাসেন।
আমরা জানি, ইলমে দ্বীন ইসলাম হচ্ছে এক অনিবার্য আলোর নাম। এ আলোর সন্ধান যারা পেয়েছেন তারা যেমন সোনা হয়েছেন, অন্যদেরও সোনায় রূপান্তর করেছেন। সেই সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীকে তারা সোনার আলোয় ভরাট করতে চেয়েছেন। বাবা হুজুর এমনই এক আলোর ফেরিওয়ালা। তিনি সারাজীবন দ্বীনের আলো, হাদিসের বাণী, সুন্নতের দাওয়াত ও কোরআনের আওয়াজকে উচ্চকিত করার মিশন নিয়ে কাজ করেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন মেধাবীদের নিয়ে, তারা যেনো প্রকৃত মানুষ হয়ে ইসলামের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করে। কারণ তিনি মন দিয়ে এটা উপলব্ধি করেছিলেন, পৃথিবীর কোনো অংশে অন্ধকার স্থায়ী হলে সেখানে কোনো কিছু বেঁচে থাকতে পারে না। ঘনকালো আঁধারে তলিয়ে যায় জীবজন্তু, গাছপালা, পাহাড়পর্বত, নদীনালা, বনজঙ্গল সবকিছু। আলোর স্থায়ী অনুপস্থিতি পৃথিবীর কোনো অংশকে ব্ল্যাকহোলে রূপান্তর করতে পারে সহজেই। তাই আলোর উপস্থিতি পৃথিবীতে অনিবার্য। আলোর আরেক নাম জীবন। এর অভাব হলে সবকিছু অচল হয়ে পড়ে। স্থবির হয়ে যায় সৃষ্টিজগত। এই আলো জ্বালানোর কাজটিই আজীবন করেছেন মাওলানা মুমতাজুল কারিম বাবা হুজুর। সবার প্রিয় বাবা হুজুর যেমন নিজে আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন, তেমনই তার সন্তানসম ছাত্রদেরও তিনি চেয়েছিলেন সত্য ও সুন্দরের আলোয় উদ্ভাসিত করতে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তিনি। তার অভীষ্ট লক্ষ্য ছিলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তিনি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন অনুসরণের মাধ্যমে নিজকে পরিচালনা করতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। যেকোনো প্রয়োজনে তার শাগরিদ, ভক্ত ও অনুরাগীরা সব সময় তার সুপরামর্শ পেয়েছেন। এভাবে নানা কর্মের মাধ্যমে তিনি মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বের এই মানুষটি তার কর্মময়জীবনকে একটি সুনির্দিষ্ট ছকে পরিচালনা করেছেন। সেটা হলো, সত্য-সুন্দরের পথে, আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লামের প্রদর্শিত জীবনের পথে। তিনি যেখানে জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, সেখানে পার্থিব কোনো লোভ-লালসা তাকে কখনো বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারেনি, বরং ‘লোভ’ নামক রিপুকে তিনি সফলতার সঙ্গে পরাভূত করতে পেরেছিলেন। লেনদেনে তার স্বচ্ছতা ও সততার বিষয়টি শত্রু-মিত্র, পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে সর্বমহলে প্রশংসিত। সততার এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সবার জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক