| |
               

মূল পাতা রাজনীতি ‘জাতীয় শিক্ষা সংকট ও বিতর্কিত শিক্ষাক্রম ২০২৩: উত্তরণের উপায়’


‘জাতীয় শিক্ষা সংকট ও বিতর্কিত শিক্ষাক্রম ২০২৩: উত্তরণের উপায়’


ড. মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সাল     10 February, 2023     06:57 PM    


বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের উদ্যোগে “জাতীয় শিক্ষা সংকট ও বিতর্কিত শিক্ষাক্রম ২০২৩: উত্তরণের উপায়” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ (১০ ফেব্রুয়ারি) শুক্রবার, সকাল ১০টায় রাজধানীর তোপখানা রোডস্থ ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।  “জাতীয় শিক্ষা সংকট ও বিতর্কিত শিক্ষাক্রম ২০২৩: উত্তরণের উপায়” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক, গবেষক সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি ও খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব ড. মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সাল।

শিক্ষা : মানুষের অভ্যাস ও আচরণের সুপরিবর্তনই হলো শিক্ষা। শিক্ষা জীবন থেকে উঠে আসা একটি প্রত্যয়। শিক্ষা সবসময়ই ইতিবাচক। তাই অশিক্ষা বা কুশিক্ষা নামে কোন প্রত্যয় শিক্ষা গবেষণায় নেই। দুনিয়ার প্রায় সকল শিক্ষাবিদই এ বিষয়ে একমত যে, শিক্ষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য চরিত্র গঠন। শিক্ষা সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকগন যে মতামত দিয়েছেন তার নমুনা দেখা যাক-

মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কারই হল শিক্ষা-- সক্রেটিস।
দেহমনের সুষম ও পরিপূরণ বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের প্রকৃত মাধুর্য ও চরম সত্যে উপনীত হওয়ার কৌশলই শিক্ষা- এরিস্টটল।
শিশুর নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী দেহমনের পরিপূর্ণ ও সার্বিক বিকাশ সাধনই হল শিক্ষা- প্লেটো।
সুঅভ্যাস গঠনের নামই হলো শিক্ষা- রুশো।
সুন্দর বিশ্বস্ত এবং পরবর্তী জীবনের উপলদ্ধিই হলো শিক্ষা- এফ ফ্রয়েবল।
জীবনের প্রস্তুতি নয়, জীবনের উপলদ্ধিই হলো শিক্ষা- জন ডিউই।

শিক্ষাক্রম : শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনাকে বলা হয় শিক্ষাক্রম। কোনো একটি শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কী বিষয়বস্তুর মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে; কখন, কীভাবে, কার সহযোগিতায় এবং কী উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত হবে, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে এসবের যাবতীয় পরিকল্পনার রূপরেখাকে শিক্ষাক্রম বলে। শিক্ষাক্রমের চারটি মূল উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়: ১. উদ্দেশ্য ২. বিষয়বস্তু ৩. শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল ৪. মূল্যায়ন। অন্যদিকে যে কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উপাদান চারটি। যথা- ১. শিক্ষার্থী ২. শিক্ষক ৩. শিক্ষাক্রম; এবং ৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, নির্ভরশীল এবং পরিপূরক। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও উন্নয়নকালে এর প্রত্যেকটি উপাদান সম্পর্কে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়। যেকোন শিক্ষাক্রম শিক্ষক- শিক্ষার্থী উভয়কে যে কমন সুবিধা দেয় তা হচ্ছে শিক্ষক জানেন শিক্ষার্থীর আচরণিক উদ্দেশ্য কি বা তারা কি শিখবে এবং শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য কিভাবে অর্জিত হবে। এজন্য পাঠ্যপুস্তক তৈরী এবং তার বিষয়বস্তু সাজানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহৃত ভাষার অভ্যন্তরে যে সুর লুকায়িত থাকে তা শিক্ষার্থীদের আচরণিক উদ্দেশ্যকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। হার্নিশ এবং ব্রিজেস (২০১১) গবেষণায় দেখা গেছে সিলেবাসে ব্যবহৃত উষ্ণ বা শীতল ভাষা শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষণের উপর বিশাল প্রভাব তৈরী করে।

শিক্ষাক্রম ২০২৩ : শিক্ষাক্রম ২০২৩ এর উল্লেখযোগ্য কিছু নিক।
১ জানুয়ারি ২০২৩ হতে ১ম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে শুরু হবে ২০২৪ সালে। ৫ম ও ১০ম শ্রেণীতে চালু হবে ২০২৫ সালে। একাদশে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশে ২০২৭ সালে চালু হবে।  দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বই পড়তে হবে। বিভাগ বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিকে উঠে। ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা হবেনা। প্রাথমিকে মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। মাধ্যমিকে কিছু পরীক্ষা আর কিছু শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। একাদশ-দ্বাদশে ৭০ শতাংশ সামরিক এবং ৩০ শতাংশ শিখনকালীন। জিপিএ পদ্ধতি উঠে যাবে। প্রারম্ভিক, অন্তর্বর্তী বা মাধ্যমিক এবং পারদর্শী এ তিনটি গ্রেডে ফলাফল হবে। # শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে বোর্ডের অধীনে দুটি পরীক্ষা হবে।  প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণি থেকে উচ্চতর গণিত উঠিয়ে দেয়া হয়েছে, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের সাথে প্রযুক্তি ঢুকিয়ে বিজ্ঞান নামক একটি বিষয় প্রস্তাব করা হয়েছে। শেখানো ও মূল্যায়নের ধরণ বদলেছে। অভিযোজনে সময় লাগবে।

শিক্ষাক্রম ২০২০ এ নিঃসন্দেহে বেশ কিছু ভালো নিক আছে। তবে একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম বিতর্কিত থাকতে পারেনা। আজকে বিতর্কিত ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এ শিক্ষাক্রমে বেশকিছু ভুল, বিকৃত ও বিতর্কিত বিষয় স্থান পেয়েছে। শিক্ষার পরিকল্পনা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে যা খুশি তা-ই করার বাড়াবাড়ি দেখে মনে হচ্ছে, শিশুদের কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয়গুলো অনুধাবন করা হয়নি। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন শিক্ষার্থী গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে এর প্রমান নেই। একদিকে বিবর্তনের মত অবস্তর তত্ত্ব আর অন্যদিকে বিজ্ঞান বিষয়ের সংকোচন উল্টো বার্তা দেয়। পাশাপাশি একই দেশে ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়বে তারা সব বিষয়ে অধিক পড়বে এবং অধিক জানবে। ফলে এক দেশে দুই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মাঝে বড় ধরণের ভারসাম্যহীনতা তৈরী করবে। আমাদের মূল শিক্ষাক্রম কারিগরি শিক্ষায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আইটি, প্রযুক্তি, কারিগরি ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বড়জোর দক্ষ কর্মী হবো। কিন্তু কোনভাবেই উদ্ভাবনী জাতিতে পরিণত হতে পারব না। বিজ্ঞান শেখার আগে আইটি, প্রযুক্তি ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া মূলত কারিগরি শিক্ষাক্রমের কাজ। মূলস্রোতকে এর ভিতর আবদ্ধ করা দূরদৃষ্টির পরিচায়ক নয়।

৩টি বিষয়ে ৯টি ভুল হয়েছে মর্মে এনসিটিবি স্বীকার করেছে। যেমন দশম শ্রেণীর ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ে ২৬ মার্চে (যা হবে ২৫ মার্চ) গণহত্যা শুরু হয়েছে, ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়ান বিচারপতি আবুসাদাত মো সায়েম হবে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী) ইত্যাদি। ওয়েবসাইটে সেসব সংশোধনী দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ভুল আছে যেমন যুক্তফ্রন্টে ৪টি দলের কথা বলা ক্লোফতে রাব্বানী পার্টির নাম বাদ দেয়া। ৫ম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে দেখানো হয়েছে ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে (মন্ত্রণালয়ের তথ্য হচ্ছে ৪০ ভাগ), জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ২০ ভাগ (মন্ত্রণালয় তথ্য হচ্ছে ১১.১২) অথচ ১০ম শ্রেণীর বইয়ে লেখা হয়েছে ১১.১২ ভাগ। অষ্টম শ্রেণির 'বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে দেশের ভয়াবহ বন্যার সালগুলো উল্লেখ থাকলেও ১৯৮৭, ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালের বন্যার খবর নেই। একাধিক বইয়ে বখতিয়ার খলজী অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন- দখল করেছেন এজাতীয় লিখা হয়েছে। কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সোর্সই এ ধরনের কথার সত্যতা প্রমান করে না। অষ্টম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত 'বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে ১২৪ পৃষ্ঠায় আদিবাসীদের উৎসবের পরচিত দিতে লেখা হয়েছে- 'নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার জন্য পালিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বৈসাবি বা বিষ্ণুর বাঙালির পহেলা বৈশাখ আজ একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। নতুন ধান মাড়াইয়ে বাঙালির নবান্ন আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওয়ানগালা একই সূত্রে গ্রোথিত। প্রথমত, বৈসাবি আর বিষ্ণু একই বিষয় নয়। বৈসাবি হলো বৈসু (ত্রিপুরাদের), সাংরাই (মার্মাদের) আর বিষ্ণুর (চাকমা) সংক্ষিপ্ত রূপ। সেটি কোনোভাবেই শুধু বিছুকে বোঝায় না। আর ওয়ানগালা শুধু মান্দিদের উৎসব, সব নৃগোষ্ঠীর নয়। 'সংস্কৃতি'তে সাবহেডে লেখা হয়েছে ‘বর্তমানে নৃগোষ্ঠীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার এবং খাদ্যাভ্যাসে বাঙালিদের পোশাক (শার্ট, প্যান্ট, থ্রি-পিস), অলংকার (ইমিটেশন) এবং খাদ্যাভ্যাস (ভাত, মাছ, কোমল পানীয়) ইত্যাদি নিজেদের জীবনে ধারণ করেছে।' শার্ট, প্যান্ট, থ্রি-পিস, অলংকার (ইমিটেশন) বাঙালিদের পোশাক? আর কোমল পানীয় বাঙালির খাবার? ভুল, তথ্য গরমিল আর হাল নাগাদ তথ্য না দিতে পারা একটি বড় ব্যর্থতা। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, অভিযুক্ত লেখকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে শরিফা গল্প সমকামীতা বিষয়ে উৎসুক্য তৈরী করবে। আর্যদের ভয়ঙ্কর বর্ণভেদ প্রথার প্রশংসা করা হয়েছে। বিশেষ করে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে সাম্প্রদায়িকতার সুসম্পষ্ট ছাপ আছে প্রচ্ছদে, ছবিতে এবং লেখায়। সুলতানী আমলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা লুকানো হয়নি। ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ম্লান করে দেয়ার চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। হিজাবের বিরুদ্ধে কল্পিত গল্প ফাঁদা হয়েছে। ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে তথাকথিত বিবর্তনবাদকে চাতুর্যতার সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জেদারো সভ্যতার আলোচনা আসাটি খুবই স্বাভাবিক। তাদেও চুলচেরা বর্ণনা এসেছে, তারা বেদের অনুসারি ছিলেন এবং বেদের প্রকারভেদ নিয়েও রীতিমত আলোচনা এসেছে। এটি মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে বয়ঃসন্ধির নির্লজ্জ উপস্থাপনা এত ছোটদের অনুধাবন স্তরের সাথে জুলুমই বটে। যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা না করে এসব করা হয়েছে তা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কথা থেকে পাওয়া যায়।

জাতীয় শিক্ষা সংকট :  আমাদের শিক্ষায় সংকট বহুমাত্রিক। এর কিছু দিক আলোকপাত করা হলো-
এক. জীবনদর্শনের অনুপুস্থিতি: জাতীয় শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর যেমন- ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা বোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী গঠনে ইসলাম সহায়তা করে। অন্ধত্ব ও কুসস্কারকে ইসলাম প্রতিরোধ করেছে। মূলত জ্ঞানের শূণ্যতার কারনে কেউ কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে বললেও সার্বিক বিবেচনায় ধর্মই হচ্ছে শিক্ষাকে পূর্ণাঙ্গ করার মাধ্যম। নৈতিক ও জবাবদিহীতামূলক প্রজন্ম গড়তে ধর্মীয় আদর্শের কোন ভিত্তি চিন্তা করা হয়নি। সামগ্রীক কোনো জীবনদর্শনের প্রতিফলন শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যসূচীতে নেই। তার উপর ঘোষিত নীতির ছাপও সিলেবাসে পড়েনি।

দুই. শিক্ষা ব্যয় ও অপর্যাপ্ত শিক্ষা বাজেট: আমাদের শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। মাথাপিছু শিক্ষাব্যয়ে আছে মারাত্মক বৈষম্য। বাংলাদেশে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে পরিবার। শিক্ষা উপকরণের বারবার মূল্যবৃদ্ধি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্থ করছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর 'গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোটং-২০২২' প্রকাশিত হয়েছে গত ৩ জানুয়ারি ২০২৩। ইউনেস্কো বলছে- করোনা মহামারীর পর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় শিক্ষার ব্যয় বেড়েছে, ফলে অনেক পরিবার সন্তানের শিক্ষার খরচ জোগাতে ঋণগ্রন্থ হয়ে পড়েছে। প্রাইভেট টিউশন, শিক্ষা উপকরণসহ শিক্ষাসংক্রান্ত খরচগুলো সরকারি- বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একই। ফলে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে এটি অনেক পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিন. অপরিকল্পিত শিক্ষাক্রম ও সমন্বয়হীনতা: মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অপরিকল্পিতভাবে ঘন ঘন সিলেবাস পরিবর্তন, মূল্যায়ন পদ্ধতির গবেষণাহীন প্রয়োগ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের সমন্বয়হীনতা, শিক্ষকদের বিদ্যমান জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় না নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের লেআউট ও শিক্ষার্থীদের অনুধাবন স্তরের বিপরীতে বিষয় বস্তু সাজানো, বিজ্ঞান বিষয়ের সংকোচন, শহর ও গ্রামে শিক্ষার পরিবেশের ভিন্নতা শিক্ষায় বড় ধরণের বৈপরীত্য ও সংকট তৈরী করেছে।

চার. অদক্ষ শিক্ষা প্রশাসন: টেক্সটবুক একমাত্র উপকরণ নয়, এখন অবারিত তথ্য প্রবাহে সবাই প্রবেশ করতে পারে। পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য, ইতিহাসের বিকৃতি শিক্ষার্থীরা সহজেই ধরতে পারে। অথচ বাধ্য হয়ে তাদের টেক্সটবুক অনুসরণ করে উত্তর লিখতে হবে। আবার ভুল লেখে কেউ নাম্বার পাবে এবং সঠিক লিখে নাম্বার পাবেনা। এভাবে সীমাবদ্ধতার মাঝে একটি হীনমন্য জাতি তৈরী হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা কিংবা দুর্নীতির মাধ্যমে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব, শিখন ও শিক্ষণ পদ্ধতির অস্পষ্টতা শিক্ষা প্রশাসনে অদক্ষতার জোয়ার এনেছে। বিশেষ করে সরকারী স্কুলগুলে তে বিভিন্ন পরীক্ষা বা অপরাপর কারণে বছরের বড় একটি সময় একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারীর কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম স্কুল বন্ধের মধ্য দিয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস জাতির লজ্জার বড় একটি কারণও বটে।

পাঁচ. জ্ঞানের স্থানান্তর না হওয়া: আমরা বিগত সময়ে জিপিএ এসএসসিতে ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের অবস্থা দেখেছি। কারো কারো তা অষ্টম শেণির উপযোগিও নয়। অস্টম শেণির শিক্ষার্থী যদি নিজে নিজে নবম শ্রেনির পাঠ ধরতে না পারে অথবা ৫ম শেণির শিক্ষার্থী ষষ্ঠ শ্রেণিতে গিয়ে পাঠ বুঝতে না পাওে তাতে বুঝা যায় জ্ঞানের স্থানান্তর হচ্ছেনা। একই অবস্থা শিক্ষা জীবন শেষ কওে কর্মক্ষেত্রে গিয়েও হয়। এটি আমাদেও শিক্ষাব্যবস্থার বড় একটি সংকট।

উত্তরণের উপায় : আজকের এই ক্ষুদ্র পরিসরে সার্বিক উত্তরণের উপায় বলা সম্ভব নয়। আমরা কয়েকটি সুপারিশ করছি।

এক. ইসলামী শিক্ষা দর্শনের আলোকে সামগ্রিকভাবে শিক্ষাক্রম তৈরী করা। এতে করে শিক্ষার সকল পর্যায়ে নৈতিকভাবে শক্তিশালী, সৎ, দক্ষ ও মানবিক মানুষ গড়ে উঠবে।

দুই. বিষয়ভিত্তিক দক্ষ শিক্ষাবিদ, শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী, আলেম, পেশাজীবি, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ও মেধাবী শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের শেখার স্তরের সাথে সামঞ্জস্য করা নিশ্চিত করতে হবে।

তিন. শিক্ষায় মোট জিডিপির ৫ % বরাদ্ধ করা এবং দক্ষতার সাথে বৈষম্যমুক্ত ভাবে শিক্ষার বরাদ্ধ বন্টনের ব্যবস্থা করা। সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা

চার. যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা, মেধাবী যুবকদের শিক্ষা পেশায় আনতে হবে। উপযুক্ত ও যোগ্য শিক্ষক দুর্নীতির কাছে যেন হেরে না যান।

পাঁচ. শেখার দক্ষতা উন্নত করা ও শিক্ষকদেরকে নিয়মিত প্রশিক্ষনের আওতায় রাখা। শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে পিতামাতা, পরিবার এবং সমাজের ভূমিকাকে কাজে শক্তিশালীকরণ।

ছয়. শিক্ষার্থীদের শেখার মূল্যায়ন যাতে শিক্ষার্থীদের শেখার স্তর এবং নির্দিষ্ট চাহিদার জন্য পরিচালিত করা যায়।

সাত. জাতীয় রাজনীতির ছায়া থেকে ছাত্র রাজনীতিকে মুক্ত রাখতে হবে।

আট. প্রশিক্ষিত ও শিক্ষিত বেকার যুবকদের যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।

নয়, কারিগরী শিক্ষার স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখে, মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষাকে আরো প্রসারিত করতে হবে।

দশ. জ্ঞানের স্থানান্তর অবশ্যই শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের সন্তানদের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যাশা করছি। আল্লাহ আমাদের ভালো কর্মপ্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন। আমিন।

লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, খেলাফত মজলিস ও প্রাক্তন সভাপতি,বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস