রহমত ডেস্ক 12 March, 2022 03:46 PM
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২০১৩ সালে আইসিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে ৫৭ ধারা যোগ করে এবং ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের জনগণ এবং মিডিয়ার বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত করার পর এখন অবশিষ্ট সামান্য যে বাকস্বাধীনতা টুকু রয়েছে সেটুকু পুরোপুরি কেড়ে নেয়ার জন্য সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি নতুন নীতিমালা বা রেগুলেশন জারির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে- কোন নিবর্তনমূলক আইন দিয়েই তথ্যের প্রচার বন্ধ করা যায় না। মানুষ সত্য জানার আগ্রহ থেকেই তারা সত্য তথ্যটির উৎস খুঁজে বের করে। সেই কারণেই সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে এসেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং তারপর এসেছে এই অনলাইন ভিত্তিক বিকল্প সামাজিক মাধ্যম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এই নীতিমালা প্রণয়নের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হচ্ছে সত্য কে আড়াল করে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠরূদ্ধ করে একদলীয় বাকশালী কায়দায় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। আজ (১২ মার্চ) শনিবার দুপুরে গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসনের দলীয় কার্যালয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, গত ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ তারিখে বিটিআরসির ওয়েবসাইটে দেওয়া ও ইংরেজিতে লেখা খসড়া নীতিমালাকে ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’ হিসেবে উল্লেখ করে ৫ মার্চ ২০২২ তারিখের মধ্যে পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ তারিখে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’ শিরোনামে আরেকটি খসড়া নীতিমালা দিয়ে সংশোধন/মতামত চাওয়া হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখের মধ্যে। নিবর্তনমূল এই দু’টি নীতিমালা কার্যকর করা হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অনলাইন ভিত্তিক মিডিয়াগুলোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে, পাশাপাশি অনলাইন এনক্রিপশনকে অকার্যকর করে নিরাপত্তাকে দুর্বল করে ফেলবে। এর ফলে মানবাধিকারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এবং সাংবাদিক, বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী এবং ধর্মীয় ও সাংষ্কৃতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্টী আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
তিনি বলেন, বিটিআরসির খসড়া নীতিমালার প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ‘মধ্যস্থতাকারী’ (ইন্টারমিডিয়ারি) হিসেবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সংজ্ঞায়িত করে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তার দায়িত্ব বর্ণনা করে লেখা হয়েছে- তিনি/বা তারা এটা নিশ্চিত করবেন যেন সামাজিক মাধ্যমসহ অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে ১৫টি বিষয় নিয়ে লেখা, ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রচার করা না হয়। এর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা অথবা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়; ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিকে আঘাত করে এমন বিষয়; সরকারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে এমন বিষয়; বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়; কোনো ব্যক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, হুমকি বা ভীতি-প্রদর্শক ও অপমানজনক বা মানহানিকর এমন বিষয়। সোজা কথায় বলা যায় এই নিবর্তনমূলক নীতিমালাটির তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি-অপশাসন, তাদের ভোট ডাকাতি, তাদের মানবাধিকার লংঘন এবং গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলোর প্রচার ঠেকাতে। এমনকি এই বিষয়গুলো যেন আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়াতে প্রচার হলে সেগুলো বাংলাদেশর জনগণ দেখতে না পায়, সেই জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’ টি প্রনয়ণ করা হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, হইচই এবং অ্যামাজন প্রাইম-সহ বিনোদনের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোকে বাংলাদেশে তাদের সম্প্রচার চালাতে হলে সেই একই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিটিআরসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এই দুটি নীতিমালা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিকই নয় বরং জাতিসংঘ ঘোষিত ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (ইউ ডি এইচ আর) এবং ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্যান্ট অন সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আই সি সি পি আর) এর পরিপন্থী। সেই সাথে জাতিসংঘের অনুমোদিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ম্যানিলা প্রিন্সিপাল এবং সান্তা ক্লারা প্রিন্সিপাল এর সিদ্ধান্তের দৃষ্টিতে দেখলে এই দুটি নীতিমালা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘণ। গত ৭ মার্চ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান কে এই বিষয়ে জানানো হয়েছে। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এমনিতেই তলানীতে এমনকি মিয়ানমারের চেয়েও পেছনে। সরকারের এই দুই নীতিমালা তাদের দুর্নীতি অপশাসন আর গুম খুনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের প্রচার থামাতে না পারলেও মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও পিছিয়ে উত্তর কোরিয়ার কাতারের গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা বাংলাদেশের এমন অসম্মান দেখতে চাই না। সেই কারণে দেশের জনগণের বাক স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম এবং দেশি-বিদেশি ওটিপি প্ল্যাটফর্মের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে বিটিআরসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এই দুই নীতিমালাসহ ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করতে হবে। নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।