| |
               

মূল পাতা ইসলাম হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অধ্যাপিকা ‘আড়ং’ নিয়ে যা বললেন


হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অধ্যাপিকা ‘আড়ং’ নিয়ে যা বললেন


রহমতটোয়েন্টিফোর প্রতিবেদক     16 March, 2021     04:10 PM    


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিতু কুন্ডু তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব (কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন) নিয়ে দীর্ঘ ২৯ বছর গবেষণার পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন কয়েক বছর আগে। বিষয়টি সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন। রিতু কুন্ডু ধর্মান্তরিত হয়ে নিজের নাম পরিবর্তন করে আদ্রিতা জাহান রিতু রেখেছেন।

মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) এক ফেসবুক পোস্টে সম্প্রতি আড়ংয়ে দাড়ি রাখার কারণে এক ছাত্রের চাকরি না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তার ফেসবুক পোস্টটি রহমতটোয়েন্টিফোরের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো :

আড়ং-এর ঘটনা কি সত্যিই বাংলাদেশে নতুন!
আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক আজকের দিনেই ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই আমি। সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানোর আগে আমার ধারণা ছিল পরিবার থেকে মেইন বাঁধাটা আসবে। তাই খুব দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেন পরিবারে এটা সহজ করে দেন। আলহামদুলিল্লাহ,  আল্লাহ পরিবারে এতটাই সহজ করে দিলেন যে আর কোন বাঁধাই থাকলো না। এর প্রায় মাস দেড়েক পর অফিসে যোগদান করলাম। কাগজপত্র, দৌড়া দৌড়ি, ইসলামিক লেখাপড়া সব একসাথে চলছিল।

রমাদান সেবার জুনে। আমার ভয় জীবনে প্রথমবার টানা এতগুলো রোযা রাখতে পারবো তো!!! আল্লাহ! যদি না পারি, একটা রেখে যদি অসুস্থ হয়ে যাই। এসব সাত পাঁচ ভেবে শাবানেই রোযা রাখা শুরু করলাম যেন রমাদানে কেমন থাকি বুঝতে পারি, কোন রোযা বাদ না যায়, আলহামদুলিল্লাহ। তখনও শাবানের রোযার ফজীলত জানতাম না।  মহামানব আসলে সকল মানবের গতিবিধি জানতেন বলেই এত মাধূর্যময় সুন্নাহ রেখে গেছেন। শাবানের রোযার ফজীলত জেনে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল। হায়, ১৪০০ বছর আগেই তিনি আমার মনের শঙ্কা জানতেন, সুন্নাহয় তাই প্র‍্যক্টিস রোযা দিয়ে গেছেন। জীবনের প্রথমবারের মতো রোযা রাখার অনুভূতিগুলো আল্লাহর আরো সন্নিকটে নিয়ে গেল আলহামদুলিল্লাহ।  

আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসার ফলস্বরূপ শাবানেই প্রথম হিজাব করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইসলামে নারীদের চুল ও সতর ঢাকা কুরআনের আলোকেই ফরজ। এতদিন কোন সমস্যা না হলেও প্রথম অনুভব করলাম আমার মেইন যুদ্ধটা আসলে পরিবারে ছিল না, ছিল পরিবারের বাইরে। আল্লাহর বিশেষ রহমত যে আমার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় যেখানে একজন শিক্ষকের খুব বেশি হায়ারার্কির হাতের পুতুল হতে হয় না। আমরা মোটামুটি অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মত প্রকাশ ও পালনে স্বাধীন, যা বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই। সেই কর্মস্থলেই আমি এত রকম বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি, এত প্রতিবন্ধকতা এসেছে শুধু মাত্র হিজাব ও বোরকা পড়ার কারনে, অন্য যে কোন মুসলিমের পক্ষেও তা সহ্য করে টিকে থাকা কঠিন ছিল, আমার মতো রিভার্টেড যার নিজের পরিবার বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই, কর্মস্থলই একটা পরিবারের মতো তার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভবই ছিল।

যাইহোক, রমাদান পর্যন্ত সেরকম প্রেশার না এলেও রমাদান পার হওয়ার পর শুরু হল হিজাব যুদ্ধ। এখানে কেউ আড়ং এর মতো বোকা না, সরাসরি বলে দেবে, বরং উচ্চশিক্ষিতের বাঁধাও অনেক উচ্চাঙ্গ! যাই হোক সে যাত্রায় টিকতে পারলাম না। হিজাব পড়া ছাড়ার মধ্যেই সময় চলতে থাকলো। রেগুলার পড়ি, অনুষ্ঠানগুলোতে সবার মতো। এভাবে অনেকদিন পাড় হওয়ার পর একদিন আল্লাহর কাছে কাঁদছিলাম একটা জিনিসের জন্য। আর মনে মনে ভাবছিলাম আল্লাহ আমি ওয়াদা করছি, আর হিজাবের বরখেলাপ করবো না। আলহামদুলিল্লাহ কয়েক মিনিটের মাঝেই আল্লাহ যা চাইলাম তা তো দিলেনই, সেই সাথে আরেকটি অকল্পনীয় খুশি ফেরত দিলেন, আর আমিও হিজাবে স্থায়ী হয়ে গেলাম।

এবার শুরু হল প্রত্যক্ষ বাঁধা। কাল থেকেই কাঠমোল্লার চেহারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, আগে যেমন চলতে তেমনই চলতে হবে। মুসলিমরাও কেউ তোমার মতো পর্দা করে না।।জঙ্গী, ইরানী, আফগানি কত কি।

আমি কি করে বোঝাই, এ তো আল্লাহর সাথে আমার সম্পর্ক, এ তো আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চাওয়ার একটা পোষাক মাত্র। আমি ওয়াদা করা মাত্র আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে একটা জিনিস চাওয়ার বিনিময়ে দুটো সৌভাগ্য দান করেছেন মুহূর্তেই। এ তো কোন বাঁধার সামনে নত হবার নয়।

আমার আনন্দ আল্লাহ আমাকে সামান্য একটু ত্যাড়া করে বানিয়েছেন আর হেদায়েতের পথে সবসময় সাহায্য করেছেন বলেই সে যাত্রায় শুধু টিকলামই না, বরং যেদিন হিজাব ছাড়তে বলা হল সেদিনই বাজারে গিয়ে কাপড় কিনে এক রাতের মাঝে বোরকা সেলাই করিয়ে সকালে অফিস করলাম আলহামদুলিল্লাহ।।। আল্লাহর পথে যেকোন প্রতিবন্ধকতা, যে কোনও বাঁধাও যে নেয়ামত সেদিন টের পেলাম আলহামদুলিল্লাহ।  নয়তো এই পরিবেশে বোরকা শুরু করতে আরো দেরিও হতে পারতো!

এক বোরকার জন্য কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত, কত খোঁচা শুনতে হয়েছে, কত অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়েছে, কত হক কেড়ে নেয়া হয়েছে, কতটা আলাদা জীবন যাপন করতে হয়েছে তা আমি জানি। তবে ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আমাকে এসব সহ্য করতে হবে তা আমার ধারণার বাহিরে ছিল। অথচ এ দেশেই আমাদের পর্দাসহ সুন্নাহ পালন সহজ হওয়ার কথা ছিল!!! তবে বাঁধা মানুষকে নিজের ঈমান চিনতে সাহায্য করে। গত চার বছরের সব বাঁধার কথা যখন ভাবি, নিজের ঈমানকে আরো সুদৃঢ় অবস্থানে খুঁজে পাই। আলহামদুলিল্লাহ।

আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ার সন্তুষ্টি নস্যি। দুনিয়ার সাফল্য তো সাময়িক, আজ আছে কাল নেই, তাই কি হবে একটা চাকরি না পেলে, বা হক থেকে কেউ বঞ্চিত করলে, বা দুটো কথা শোনালে, সমাজের কাছে গৃহীত না হলে, আড়ং এ শপিং না করলে!

আসুন আল্লাহকে ভালোবেসে, রাসূলের সুন্নাহকে ভালোবেসে এবারের ঈদটা আড়ংবিহীন ঈদ হিসেবে উদযাপন করি। সেদিনই আড়ং এ যাই যেদিন ওদের সব পুরুষ বিক্রয়কর্মী দাড়ি রাখবে আর নারী বিক্রয়কর্মী হিজাব পড়বে, তার আগে নয়, দুনিয়া তো সাময়িক, আল্লাহর ওয়াদাই তো সর্বোত্তম, চিরস্থায়ী।

এর আগে ভিডিও বার্তায় ওই শিক্ষিকা তার ইসলামগ্রহণ সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, ‘দীর্ঘ ২৯ বছরের বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা ও জ্ঞান-বুদ্ধির আলোকে আমি ইসলামের বিষয়ে এক মাসব্যাপী পড়াশোনা শুরু করি। ১৬ দিনের মধ্যেই আমি সত্য উপলব্ধি করি এবং ২০১৭ সালের মার্চে ইসলাম গ্রহণ করি।এই দীর্ঘ ২৯ বছর পর্যন্ত আমি নিজের পরিবার, সমাজ ও মানুষের আচার-ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করি। এ দীর্ঘ সময় অন্যান্য প্রধান সব ধর্মের গ্রন্থাবলি পাঠ করেছি। জাপানেও এ বিষয়ে পড়াশোনা করি। ২০১২ সালে এসে বুঝতে পারি, এগুলো মানুষ রচিত বই (ঐশী বাণী নয়)।’

তিনি যোগ করেন, ‘দীর্ঘ ২৯ বছর পর আমি পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ নিয়ে পড়ালেখা করি। এর পাশাপাশি আমি হাদিসও পাঠ করি। সামনে কোরআনের যে সূরা আর হাদিস পেয়েছি তাই মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। মহান আল্লাহর নির্দেশনার কারণ ও বিধি-নিষেধ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি। কখনও এ বিষয়ে স্বপ্নও দেখেছি। তা হয়ত অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে।’

তিনি যোগ করেন, ‘খুব ছোট থেকেই হয়ত আল্লাহ আমাকে ইসলাম কবুলের জন্য তৈরি করেছিলেন। ছোট থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ঘটনা, শিক্ষা, প্রতিবন্ধকতা আর সমাজের অসংগতি আমাকে ধীরে ধীরে ইসলামের পথে পরিচালিত করেছে। আমি যখন বুঝতে পারলাম, আমাকে নামাজ পড়তে হবে সেদিন থেকে টানা ১৪ মাস আমার নামাজ কাযা হয়নি। এরপর চাকরির কারণে দু-একবার কাযা হয়ে যায়। আমি যখন অনুভব করলাম, আমাকে পর্দা করতে হবে সেদিন থেকে আমি হিজাব পরা শুরু করি।’

পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন বলেও জানান এ শিক্ষিকা।

বলেন, ‘আমার পরিবার ও বন্ধুরা আমাকে এমনটি করতে মানা করে। কিন্তু আমি তাদেরকে বলি,  আমি রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসতে পেরেছি। আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি কেন আমাদের এত সুন্দর সুন্দর উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। আজ থেকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করলাম।’

(ফেসবুক পোস্টের বানান ও মতামত রিতু কুন্ডু ওরফে আদ্রিতা জাহান রিতুর নিজস্ব)

-জেড