| |
               

মূল পাতা ইসলাম ইসলামী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য


ইসলামী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য


মুফতি ইলিয়াস মাদারীপুরী     06 February, 2021     12:51 PM    


বর্তমানে এমন একটি বিপর্যস্ত সময়ের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যখন প্রবলভাবে ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ইসলামি অর্থব্যবস্থার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো এ লেখায়।

১. ইসলামী অর্থব্যবস্থা হলো একটি খোদা প্রদত্ত অর্থব্যবস্থা। যা বস্তুবাদের উপর নির্ভলশীল নয়। বরং বস্তুগত দর্শনকে কঠিনভাবে প্রত্যাখান করে। অথচ পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ভিত্তিই হলো বস্তুবাদের উপর।

২. এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। কারণ ইসলামী অর্থব্যবস্থা একদিকে যেমন ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকার করে (যা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে), অপর দিকে লাগামহীন ব্যক্তিমালিকানাকেও অস্বীকার করে (যা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা স্বীকার করে)। ইসলাম একদিকে যেমন বৈরাগ্যবাদকে অস্বীকার করেছে, তেমনি বস্তুবাদকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। কোরআন ধন-সম্পদকে যেমন ফজলুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহ এবং যীনাতুল আরদ অর্থাৎ যমিনের সৌন্দর্য বলেছে, তেমনি মাতাউল গুরুর অর্থাৎ ধোঁকার শ্রেষ্ঠ সম্ভার ও ফিতনা অর্থাৎ পরীক্ষার উপকরণও বলেছে।

৩. অর্থনৈতিক তৎপরতা তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি
ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করে মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। যেমন, কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি দাউদ আ.কে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম তোমাদের জন্য, যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে’ সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৮০।
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘ফরজের উপর ফরজ হলো হালাল রিজিক অন্বেষণ করা’। হাদীস শরীফে আরও এসেছে, ‘সত্যবাদী, আমানতদার, বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীগণ হাশরের ময়দানে নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও নেককারদের সাথে থাকবে’।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বীনের অংশ তথা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হওয়ার জন্য দুটি শর্ত প্রযোজ্য। ক. নিয়ম সঠিক হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ, ভিক্ষাবৃত্তির অপমান থেকে বাঁচার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করা। খ. সম্পদ উপার্জন ও সম্পদ ব্যয় উভয়টিই শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে করতে হবে।

৪. আল্লাহর সামনে জবাবদিহির ভয়
যেমন, কোরআনে রয়েছে- ‘হে ঐ লোকেরা, যারা ঈমান এনেছো, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ। সুরা নিসা, আয়াত-২৯।

৫. জীবনোপকরণ এবং বাজারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা, অর্থাৎ কোনও পণ্যের দরদাম সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় না। তবে দরদামের মাঝে সীমাতিরিক্ত তারতম্য হলে সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাখে। কোরআনে এসেছে,‘আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করেছি, এবং একের মর্যাদাকে অপরের উপর উন্নীত করেছি’। সুরা যুখরুফ, আয়াত-৩২। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘(ব্যবসা-বাণিজ্যে পণ্যের দরদাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে) লোকজনকে তোমরা আপন অবস্থার উপর স্বাধীনভাবে ছেড়ে রাখ। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদের কতিপয়কে কতিপয়ের মাধ্যমে রিজিক প্রদান করবেন’।
তবে এ ক্ষেত্রে দুটো জিনিস প্রতিবন্ধক, এক. ধন-সম্পদ পুঞ্জিভূত করা ও সিন্ডিকেট করা। দুই. চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা।

৬. চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে স্বাধীনতা সংরক্ষণ
এটাকেই রক্ষা করার জন্য ইসলাম অনেক বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছে।
যেমন,
৬.১. ইহতিকার তথা স্টক করা। যেমন, ইরশাদ হয়েছে- ‘যে সিন্ডিকেট করবে, সে অপরাধী’।
৬.২. বাইউল হাদিরি লিলবাদী তথা শহুরে ব্যক্তির গ্রাম্য ব্যক্তির এজেন্ডারি করে ব্যবসা করা। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে- ‘রাসুলুল্লাহ সা. শহুরে ব্যক্তির গ্রাম্য ব্যক্তির এজেন্ট হয়ে ব্যবসা করতে নিষেধ করেছেন’।
৬.৩. নাজাশ অর্থাৎ মিথ্যা চাহিদা প্রকাশ করে দালালি করা। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা দালালি করো না, এবং রাসুলুল্লাহ সা. দালালি করতে নিষেধ করেছেন’।
৬.৪. সাওম আলা সাওমি আখীহি অর্থাৎ একজনের দরদামের উপর অপরজনের দরদাম করা। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে- কোনও মুসলমান যেন তার অপর মুসলমান ভাইয়ের দরদামের উপর দরদাম না করে।
৬.৫. তালাক্কিল জালাব অর্থাৎ বহিরাগত ব্যবসায়িক পণ্য বাজারে আসার পূর্বেই পথিমধ্যে তা ক্ষয় করা। ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সা. বহিরাগত পণ্য নির্ধারিত বাজারে পৌঁছার পূর্বেই তা ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন’।
৬.৬. বাইউল মাবী কবলাল কবয অর্থাৎ পণ্য আয়ত্ব দখলের পূর্বে বিক্রির নিষেধাজ্ঞা। বর্তমানে এই ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন ব্যাপক। এবং এটা প্রতারণা ও ফটকাবাজির অন্তর্ভুক্ত। ফটকাবাজি ও প্রতারণা এ কারণে যে, একই জিনিসের অর্ডার কোনও ব্যবসায়ী অন্যকে সেই জিনিস নির্দিষ্ট বাজারে পৌঁছার কিংবা তার হস্তগত হওয়ার পূর্বেই ১০-২০টি বেচাকেনা হয়ে যায়। যার আবশ্যিক পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, সাধারণ ভোক্তা শ্রেণির কাছে পৌঁছার পূর্বেই তার মূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। যে মুনায়া মধ্যবর্তী ফটকাবাজিরা লুফে নেয়। রাসুলে কারীম সা. এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনও খাদ্য (বা পণ্য) বিক্রি করবে, সে যেন অবশ্যই তা ওজন করে বুঝে পাওয়ার পর বিক্রি করে। মুসলিম : ৩৮১১।
৬.৭. যে মাল দায় এবং ‘রিস্ক’ তথা দায়বদ্ধতার মধ্যে আসেনি, তার দ্বারা মুনাফা লাভ করা জায়েজ নেই। ‘আলখরাজ বিদ দমান’ এবং আলগুরমু বিল গুনমি’- এই মূলনীতির কারণে। এ সংক্রান্ত হাদীস হলো-
ক. দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়েই কেবল লভ্যাংশ বৈধ হয়। খ. কোনও লভ্যাংশ বৈধ নয়,যদি না তা দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। গ. লাভ যার, দায়বদ্ধতাও তার।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : সুদ হারাম হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ যে, উল্লিখিত মূলনীতি সেখানে পাওয়া যায় না। কারণ যে ব্যক্তি সুদভিত্তিক ঋণ দিয়ে (অতিরিক্ত) টাকা বা মুনাফা গ্রহণ করে, তা বস্তুত ঋণগ্রহীতার দায়বদ্ধতা বা রিস্ক-এর মধ্যে থাকে না। অর্থাৎ যদি ঐ মাল ঋণগ্রহীতার নিকট বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার দায় ও রিস্ক ঋণদাতার উপর আসে না।

৭. গরর অর্থাৎ ধোঁকাবাজি ও ফটকাবাজির নিষেধাজ্ঞা
এর দুই সুরত হতে পারে। ক. কোনও লেনদেনের মধ্যে এমন অস্পষ্টতা, যার কারণে সাধারণত লেনদেনকারী ব্যক্তিদ্বয়ের মাঝে ঝগড়াফাসাদ সৃষ্টি হয়। এটাকে জাহালাত তথা পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে অজ্ঞতাও বলা হয়। যেমন- খাবারের মতো উপযুক্ততা আসার আগেই ফল বিক্রি করা। খ. কোনও লেনদেন অনিশ্চিত হওয়া। অর্থাৎ এটা জানা নেই যে, লেনদেন কি বহাল থাকবে, নাকি নিঃশেষ হবে। যেমন, জুয়া। সেখানে জানা থাকে না যে, লেনদেন বহাল থাকবে নাকি থাকবে না।

লেখক : মুহাদ্দিস ও মুফতি, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া