| |
               

মূল পাতা বিশেষ প্রতিবেদন আল্লামা আহমদ শফী : যার তর্জনীর গর্জনে প্রথম কেঁপেছিল হাসিনার গদি


আল্লামা আহমদ শফী : যার তর্জনীর গর্জনে প্রথম কেঁপেছিল হাসিনার গদি


শেখ আশরাফুল ইসলাম     18 September, 2025     02:13 PM    


২০১৩ সালের শুরুর দিকে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগে তৈরি হয় “গণজাগরণ মঞ্চ”। এখান থেকে শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-বাহিনীর সহায়তাকারীদের শাস্তির দাবি উঠানোর কথা থাকলেও, পরবর্তীতে এটা রূপ নেয় ইসলামবিদ্বেষের। শুরু হয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে কটুক্তি।

আর সেই প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় “হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ”। স্লোগানে প্রকম্পিত হয় সমগ্র দেশ। বাংলার মুসলমানদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, “বিশ্ব নবীর অপমান, সইবে না আর মুসলমান”। 

নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সামনের কাতারে হাজির হন দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী। ডাক দেন লং মার্চের। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় হেফাজতের “লং মার্চ” কর্মসূচি। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে আগত লাখো নবীপ্রেমীদের পদচারণায় সেদিন কার্যত বন্ধ হয়ে যায় বাংলার রাজধানী। লং মার্চের মঞ্চ থেকেই উত্থাপন করা হয় ঐতিহাসিক ১৩ দফা। 

অনেকে বলেন, আল্লামা আহমদ শফীর তর্জনীর গর্জনেই প্রথমবার কেঁপে ওঠে ইসলামবিদ্বেষীদের আখড়া শাহবাগ ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গদি।

৮ এপ্রিলের হরতাল :

৮ এপ্রিলের হরতাল বেশ সফলভাবেই পালন করেছিল হেফাজত। দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সেদিন। হরতালে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। পিকেটিং, মিছিল, অবস্থান ও সড়ক অবরোধে থেমে গিয়েছিল সমগ্র দেশ। 

ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় একটি রেলগেট এলাকায় অবস্থান‐নিয়ে অবরোধ করে তৌহিদি জনতা। ফলে আটকে যায় পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, পুলিশের গুলিবর্ষণ; এমন ঘটনা দেশজুড়েই দেখা গিয়েছে। বাস ও অন্যান্য যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল সেদিন। দোকানপাট বন্ধ থাকলেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল।

৫ মে  ঐতিহাসিক অবরোধ :

প্রশাসনের ব্যাপক বাধা সত্যেও ফজরের নামাজের পর হেফাজতের নেতা-কর্মীরা ঢাকার ছয়টি প্রধান প্রবেশপথ (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম) দখল করে অবরোধ তৈরি করেন। গাবতলী, টঙ্গী, কাঁচপুর ব্রিজ ইত্যাদি পয়েন্টে শুরু হয় অবরোধ। যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, টিকাটুলি, পল্টন ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামীলীগের নেতাকার্মী ও পুলিশের সাথে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এভাবেই পুরো ঢাকা দখলে নেয় নবীপ্রেমী তৌহিদী জনতা। 

তারপর শুরু হয় সেই “কালো রাত”। এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকেই লাশের মিছিল ছুটে আসছিল শাপলা চত্তরের দিকে। দারুল উলুম মতিঝিল মাদরাসার অযুখানার পাশে দুপুরেই মগজ গলিত লাশ দেখা যায়। কিন্তু রাতের ভয়াবহতা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিআরশেল দিয়ে চালানো হয় বর্বর হামলা।

অনেকের মতে, পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির যৌথ বাহিনীর সাথে ছিল ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা। আর তাদের সাথে যুক্ত হয় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চালানো হয় ‘অপ্যারেশন শাপলা’ বা ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নামে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। 

অবরোধকারীদের অনেকেই আশপাশের ভবন ও গলি-পথ দিয়ে পালান বা আশ্রয় নেন। শত শহীদের রক্তে লাল হয় শাপলার পিচঢালা রাস্তা। ইতিহাসে তৈরি হয় “রক্তাক্ত শাপলা”। 

২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শাপলা ইসলামী জাগরণের সেই মহাপুরুষ আল্লামা আহমদ শফী ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। হাজারো শিষ্য, শুভানুধ্যায়ী ও সাধারণ মানুষ কাঁদে এই মহান আলেমের বিদায়ে। 

চলুন জেনে নেই সেই আলেমের সংক্ষিপ্ত জীবনধারা...।

শৈশব ও শিক্ষা

আল্লামা আহমদ শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি ভর্তি হন দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায়। সেখানে তিনি সুদীর্ঘ শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে দারুল উলুম দেওবন্দে পাড়ি জমান। দেওবন্দ থেকে তিনি কুরআন-হাদিস ও ইসলামি ফিকহের গভীর জ্ঞান অর্জন করে ফিরে আসেন দেশে।

শিক্ষকতা ও মাদরাসা জীবন :

দেশে ফিরে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। ধীরে ধীরে তার মেধা, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বগুণে তিনি প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার পাঠদান ছিল সহজবোধ্য, প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী। 

হেফাজতে ইসলামের আমীর :

আল্লামা আহমদ শফীর নাম সর্বাধিক আলোচিত হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর হিসেবে। তিনি ইসলামী শিক্ষা, সামাজিক শুদ্ধতা এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় তাঁর নেতৃত্বে হেফাজতের আন্দোলন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ :

আল্লামা শফী (রহ.) ছিলেন একাধারে বিনয়ী, দৃঢ়চেতা ও আধ্যাত্মিক মানুষ। তিনি কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে জীবন পরিচালনার উপর সর্বদা গুরুত্ব দিতেন। তাঁর বক্তব্যে সাধারণ মানুষ যেমন অনুপ্রাণিত হতো, তেমনি আলেম সমাজও পেতো প্রেরণা।