রহমত নিউজ 27 August, 2023 12:40 PM
বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ভারত সফর ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দলটিকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নতুন তৎপরতা শুরু হয়েছে। সাম্প্রতি দেখা গেছে, জিএম কাদের ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে একাধিক বৈঠক যেমন করেছেন, তেমনি ভারত সফরে গিয়ে বিভিন্ন মহলে বৈঠক করেছেন। দলের একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, নির্বাচন আসলেই জাতীয় পার্টিকে এ ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এটিকে তারা 'নতুন খেলা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনে 'ভারতের চাপ' ছিল। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছিল। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে থাকবে নাকি বিএনপির সাথে থাকবে - এনিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, নির্বাচন আসলেই এগুলো হয় আমাদের দলকে ঘিরে। জাতীয় পার্টি বিএনপির দিকে যাবে নাকি আওয়ামী লীগের সাথেই থাকবে। নাকি একাই নির্বাচনকে করবে এমন নানা কিছু। এবারও সেটা হচ্ছে। তবে দল নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেবে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ, তারা একই সাথে সরকারের অংশ ছিল এবং সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটি একটি বিরল ঘটনা।
জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা গোলাম মসিহ দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এইচএম এরশাদের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেন, অন্যরা যাই করুক জাতীয় পার্টির এবারের লক্ষ্য হলো- দলকে টিকিয়ে রাখতে যা করা দরকার তাই করা।
দলের ভেতরে কী ঘটছে
রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরর অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ মাঝেমধ্যে মাথাচাড়া দেয়। কারণ রওশন এরশাদ চাইছেন আওয়ামী লীগের সাথে যোগসূত্র করেই নির্বাচনের মাঠে যেতে আর জি এম কাদের মনে করছেন দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে ‘আওয়ামী লীগের বিরোধিতা’ করাই যৌক্তিক হবে।
গত কয়েকমাস ধরে সরকার বিরোধী নানা বক্তব্য দিচ্ছেন জিএম কাদের। দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি তাদের সরকার বিরোধী অবস্থান তুলে ধরতে চায়। নির্বাচনে দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এ বিষয়টিকে অনেক জরুরি মনে করেন। তবে জাতীয় পার্টির ভেতরে আরেকটি অংশ মনে করছে আওয়ামী লীগের পাশে থাকা তাদের জন্য ভালো হবে। তবে নির্বাচনে তারা একক ভাবেই অংশ নিতে চান, যাতে করে জাতীয় পার্টির সিদ্ধান্তের কারণে 'বিএনপি কোনো সুযোগ' না পায়।
গোলাম মসিহ বলেন, জাতীয় পার্টি অতীতে কখনো বিএনপির কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পায়নি বরং আওয়ামী লীগ তাদের মূল্যায়ন করেছে। জোট সঙ্গীদের প্রতি আওয়ামী লীগের আচরণ ভালো। আর নির্বাচন নিয়ে তাদের কৌশলও ভালো হয়। তবে আমাদের লক্ষ্য পার্টিকে টিকিয়ে রাখা। যদিও আমাদের কিছু নেতা আছেন যারা সবসময় ক্ষমতার কাছে থাকতে চান। তাদের কারণেই জাতীয় পার্টিকে অনেকে ব্যবহারের সুযোগ পায়।
দলের চেয়ারম্যান জি এ কাদেরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মাসরুর মাওলা বলেন, জাতীয় পার্টির কিছু নেতা নির্বাচন আসলে প্যানিক পরিস্থিতি তৈরি করে। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে বিরোধ নেই। কিছু ব্যক্তি রওশন এরশাদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে তাকে ব্যবহার করে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। এটা যখন হয় তখনই তৃতীয় পক্ষ জাতীয় পার্টিকে রাজনীতির খেলায় ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে।
রুহুল আমিন হাওলাদার অবশ্য বলছেন, নির্বাচন আসলেই এমন নানা ধরণের আলোচনা দলের অভ্যন্তরে হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে তিনি মনে করেন। “এসব নিয়ে অনেকবার বসেছি। কথা হচ্ছে। চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন”।
জাতীয় পার্টির কদর?
জাতীয় পার্টির নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে গত ডিসেম্বরেই প্রধানমন্ত্রী একটি বার্তা তাদের দিয়েছিলেন। তিনি তখন জাতীয় পার্টিকে এককভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য দল গুছানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিকে ঘিরে সরকারের তরফ থেকে কিছু চিন্তা ভাবনা আগে থেকেই চলমান আছে। এখন জি এম কাদেরের ভারত সফরের পর তাই আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে বিশ্লেষকদের কাছে। দলের নেতারা দাবি করছেন, এখন পর্যন্ত তারা পার্টিকে কারও 'খেলার গুটি' হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেননি। বিশেষ করে জি এম কাদের একটি শক্ত অবস্থান নিয়েই আছেন। তবে সম্প্রতি মি. কাদেরের ভারত সফরের পর নানামুখী আলোচনা হচ্ছে দলটিকে নিয়ে।
ভারত সফরে জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকা মাসরুর মাওলা বলেন, ভারতীয় কর্মকর্তারা শুধু তাদের বলেছেন যে তারা চান নির্বাচনে যেন জাতীয় পার্টিসহ সবাই অংশ নেয় এবং নির্বাচনটি যেন সহিংসতামুক্ত হয়। ভারত নির্বাচনে জড়িত হয় কারণ বাংলাদেশে তাদের অনেক বিনিয়োগ। তাছাড়া এখানে সহিংসতা হলে তার প্রভাব ভারতেও পড়ে। তাই তারা একটাই বার্তা দিয়েছে যে- ভারত সবার অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাইছে। আর কোনো কিছু আমাদের আলোচনায় আসেনি।
দলের একাধিক সূত্র অবশ্য নিশ্চিত করেছে পশ্চিমা প্রভাবশালী কিছু দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কারও কারও কিছু আলোচনা হয়েছে এবং সেসব আলোচনায় জাতীয় পার্টিকে এখনই কোনো দিকে হেলে না পড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলছেন নির্বাচনে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির ভেতরে দ্বন্দ্ব বিবাদ প্রকট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। এরশাদের অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের সংকট ও দলের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ জোরদার হয়েছে। এর মূল কারণ হলো সব পক্ষই চাইছে নির্বাচনের সময় যেন দলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এর জের ধরেই নানা পক্ষ তাদের ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারে।
গোলাম মসিহ বলেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকেই জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নানা গোষ্ঠী সবসময় 'খেলার চেষ্টা' করেছে। তার মতে এর কারণ হলো দেশের প্রতিটি আসনেই তাদের কিছু ভোট আছে। কমপক্ষে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত ভোট আছে প্রতিটি আসনে। আবার অন্তত একশ আসনে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয় ৫-১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে। এ কারণেই জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এতো খেলার চেষ্টা হয়।