| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক যেভাবে ভারতে পাবলিক টয়লেট বিপ্লব ঘটেছে


যেভাবে ভারতে পাবলিক টয়লেট বিপ্লব ঘটেছে


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     17 August, 2023     08:18 AM    


ভারতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণের ক্ষেত্রে একরকম ‘বিপ্লব’ এনেছিলেন যে সমাজকর্মী, সেই বিন্দেশ্বর পাঠক ৮০ বছর বয়সে মারা গেছেন। ভারতের রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন বা বাস টার্মিনালে ‘সুলভ শৌচালয়’ নামে যে পাবলিক টয়লেট দেখা যায়, ১৯৭০ এর দশকে তার সূচনা করেছিলেন তিনি। বিন্দেশ্বর পাঠকের সংস্থা সুলভ ইন্টারন্যাশনাল দাবি করে যে সারা দেশের শহরাঞ্চলেই তাদের ৯,০০০ ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ পাবলিক টয়লেট আছে এবং প্রতিদিন দুই কোটি মানুষ এই টয়লেট ব্যবহার করে। গ্রামীণ এলাকাতে তারা গত ৫০ বছরে দেড় লাখেরও বেশি টয়লেট বানিয়েছে। তবে সুলভের তৈরি সব পাবলিক টয়লেট কতটা পরিচ্ছন্ন ও সেগুলো কতোটা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়- তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনই মি. পাঠক কথিত ‘পাবলিক টয়লেট বিপ্লব’ শুরু করার প্রায় ৫০ বছর, এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার স্বপ্নের ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ শুরু করার নয় বছর পরেও ভারতে প্রকাশ্যে টয়লেট করা বন্ধ হয় নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ জুলাই মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন ভারতের গ্রামীণ এলাকার ১৭ শতাংশ মানুষ এখনও প্রকাশ্যে টয়লেট করেন। তবে ২০১৯ সালে ভারত সরকার ঘোষণা করেছিল যে দেশে কেউ আর প্রকাশ্যে টয়লেট করেন না।

বিন্দেশ্বর পাঠক ও টয়লেট ‘বিপ্লব’
সুলভ ইন্টারন্যাশনাল-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার ভারতের স্বাধীনতা দিবসে সদর দপ্তরে পতাকা উত্তোলন করেন বিন্দেশ্বর পাঠক। তারপর হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাকে দিল্লির এইমস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই মারা যান বিন্দেশ্বর পাঠক। বিহারের বাসিন্দা বিন্দেশ্বর পাঠককে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী জন্ম শতবর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করতে হয়েছিল সেই সব মানুষের সঙ্গে যারা আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করেন। সেসময় তাদের সমস্যা ও তাদের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন মি. পাঠক। তারপরেই ১৯৭০ সালে সুলভ ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এর আগে অবশ্য কম খরচে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়, এমন সামগ্রী দিয়ে টয়লেট বানানো এবং কম্পোস্ট পদ্ধতিতে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। দেশ-বিদেশের নানা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বিন্দেশ্বর পাঠক, ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার পদ্মভূষণ উপাধিও পেয়েছিলেন তিনি। ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে চীন, ভূটান, নেপালসহ দশটি দেশে টয়লেট সংক্রান্ত বিভিন্ন কারিগরি পরামর্শ দিয়েছে সুলভ ইন্টার‍ন্যাশনাল। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলেও কম খরচে টয়লেট বসিয়েছিল সুলভ ইন্টারন্যাশনাল। ওই টয়লেটগুলি দেখে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ২০১১ সালে কাবুলের নানা জায়গায় বায়োগ্যাস-চালিত টয়েলেট তৈরির কাজ দেয় সুলভ ইন্টারন্যশনালকে।

গ্রামীণ এলাকায় এখনও কেcbf প্রকাশ্যেই টয়লেট?
বিন্দেশ্বর পাঠকের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের জল ও স্বাস্থ্যবিধান সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ চণ্ডীচরণ দে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের লোকশিক্ষা পরিষদের জল ও স্বাস্থ্যবিধান বিভাগের সমন্বয়ক চণ্ডীচরণ দে বলছিলেন, “বিন্দেশ্বর পাঠকের কাজের মূল ফোকাস ছিল শহরাঞ্চল। তাই শহর এলাকায় সুলভ প্রচুর দেখা যায়। তার মধ্যে যেগুলো ওরা নিজেরা রক্ষণাবেক্ষণ করে না, ঠিকাদার সংস্থাকে দিয়ে দেয়, সেখানে সবসময়ে যে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা আছে, তা বলা যায় না। তবে এখনও যে মানুষ প্রকাশ্যে টয়লেট করেন, তা তো জুলাই মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের প্রতিবেদনেই দেখা যাচ্ছে। তারা বলছে গ্রামীণ এলাকায় ১৭ শতাংশ মানুষ টয়লেট ব্যবহার করেন না, তারা প্রকাশ্যে শৌচ করেন। গত নয় বছরে 'স্বচ্ছ ভারত' মিশনের অধীনে লাখ লাখ টয়লেট বানিয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু তা ব্যবহারের ক্ষেত্র অনীহা রয়েই গেছে মানুষের মধ্যে। সরকারি অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, টয়লেট হচ্ছে, কিন্তু সেই সব টয়লেটের বিবিধ ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। এমনকি টয়লেটকে ঠাকুর ঘর বানানো হয়েছে, এরকম উদাহরণও দেখেছি আমরা। এই স্বচ্ছ ভারত মিশনের একটা বড় সমস্যা হল এটা টার্গেট পূরণের প্রকল্প হয়ে উঠেছে। মানুষ ব্যবহার করল কি করল না, সেটা দেখা হচ্ছে না, নির্দিষ্ট টার্গেট পূরণ করা গেল কী না, সেটাই বিচার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের ‘টয়লেট ম্যান’ নামে পরিচিত রামেসিস আরপিএল পারফেক্ট পজ সংস্থার কার্যকরী পরিচালক অরিজিৎ ব্যানার্জী বলছিলেন, মানুষের মধ্যে টয়লেট ব্যবহার করা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অভাব রয়েছে। টয়লেট বানিয়ে দিলেই তো হবে না, সেটা যাতে ব্যবহার করা হয় নিয়মিত, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করা হয়, সেটাও তো দেখার দরকার ছিল। সেই কাজটা যেমন সরকারের দিক থেকে করা হয় নি সঠিক ভাবে, আবার ব্যবহারকারীদের দিক থেকেও অনীহা রয়েছে। আবার গ্রামীণ এলাকায় যেসব টয়লেট বানানো হয়েছে, সেগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকেও খেয়াল রাখা হয় নি।

শহরে টয়লেট নিয়ে নারীদের সমস্যা
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প 'স্বচ্ছ ভারত' মিশনের অধীনে সরকারি উদ্যোগে হাজার হাজার টয়লেট তৈরি হয়েছে। তবে সেইসব টয়লেটের বেশিরভাগই হচ্ছে বসতবাড়িগুলিতে। রাস্তায় ঘাটে এখনও সাধারণ মানুষের জন্য পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাব রয়েছে। আর তাতে সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় কাজেকর্মে বেরুনো নারীদের।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে কলকাতার কয়েকটি বাড়িতে রান্নার কাজ করতে আসেন তনুশ্রী শাসমল। তিনি বলছিলেন, কোনও স্টেশনে দরজা ভাঙ্গা টয়লেট তো কোথাও অত্যন্ত নোংরা টয়লেট ব্যবহার করতে তারা বাধ্য হন - কারণ কাজের বাড়িতে গৃহপরিচারিকাদের টয়লেট ব্যবহার করতে দেন না অনেকেই। অনেক নারীই আজকাল এমন সব কাজে যুক্ত থাকেন, যেগুলি কোনও নির্দিষ্ট বাড়ি বা অফিসে বসে করা যায় না। ঘোরাঘুরির কাজ যেমন থাকে, তেমনই গ্রামে গঞ্জেও দৌড়তে হয় হরহামেশাই। সেরকমই একটা পেশা সাংবাদিকতা। একটা সময়ে এই পেশায় নারীরা বিশেষ আসতেনই না, কারণ সংবাদমাধ্যমের অফিসগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটই থাকত না।

প্রায় দেড় দশক ধরে মাঠেঘাটে সাংবাদিকতা করা এক নারী, দেবযানী চৌবে বলছিলেন, তার চাকরিজীবনের সবথেকে বড় সমস্যা হল পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাব, যে কারণে তাকে একাধিক শারীরিক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এমন জায়গায় আমাদের কাজের জন্য যেতে হয়, যেখানে গোটা গ্রামেই হয়তো টয়লেট নেই। তবে সেখানে ঝোপঝাড় আছে। আবার শহরাঞ্চলে যেসব টয়লেট আমাদের ব্যবহার করতে হয়, সেগুলো এতই নোংরা যে সেখান থেকে অনেক নারীরই ইউরিন ইনফেকশান হয়ে যায়। আমাকেও এই সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। টয়লেটের সমস্যাটা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে পিরিয়ডসের সময়ে। তখন নিয়মিত প্যাড বদলানোর দরকার হয়। কিন্তু পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাবে সেটা সব সময়ে করা যায় না, যার থেকে নানা গায়েনোকলজিকাল সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

টয়লেটের সমস্যার একটা চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর সমাধান বার করেন অনেক নারীই। বাড়ির বাইরে যেতে হলে, বিশেষত দূরে কোথাও যেতে হলে অনেক নারী জলপান করেন না। এর ফলে আবার তাদের কিডনির সমস্যায় পড়তে হয়।