| |
               

মূল পাতা জাতীয় ‘মানহানি হলো আমার, আর ক্ষতিপূরণ পেলো রাষ্ট্র- এটা তো ন্যায় বিচার হলো না’


‘মানহানি হলো আমার, আর ক্ষতিপূরণ পেলো রাষ্ট্র- এটা তো ন্যায় বিচার হলো না’


রহমত নিউজ     08 August, 2023     01:58 PM    


বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ নামে যে আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে সেটি আসলে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিবর্তন আনবে না বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী এবং আইন বিশেষজ্ঞরা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাস্তি কমানোর মতো বিষয়টি নতুন আইনে অন্তর্ভূক্ত করা হলেও এটি আসলে খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বরং যেসব ধারা নিয়ে বিতর্ক ছিল সেগুলো এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছে।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের যে জায়গাগুলো নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল সে জায়গাগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রয়ে গেছে। যার ফলে এটি অপপ্রয়োগেরও সুযোগ রয়েছে এবং এটি দিয়ে নিবর্তনমূলক কার্যক্রম করারও সুযোগ রয়ে গেছে।

সোমবার (৭ আগস্ট) মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে তার জায়গায় সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে ভিন্ন একটি আইন আনার সিদ্ধান্তে অনুমোদন দেয়া হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন এনে এই আইনটি করা হচ্ছে। অনেকগুলো ধারায় জরিমানার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়েছে, কোনো কোনো ধারায় কারাদণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দেয়া হয়েছে বা কারাদণ্ড বাতিল করে জরিমানার বিধান আনা হয়েছে, দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে দ্বিগুণ জরিমানা বা সাজার যে বিধান ছিল, সেটা পুরোপুরি তুলে দেয়া হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে এই আইনটি পাসের জন্য সংসদে তোলা হবে।

এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, এখন সাইবার সিকিউরিটির যে বিষয়টা দেশ ও আন্তজার্তিক প্রক্রিয়ায় যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে সেজন্য সরকার মনে করেছে যে সাইবার সিকিউরিটির জন্য একটা আইন দরকার। সেই আইন করতে গিয়ে আগের আইনটা থেকে আমরা কিছু ধারা, কিছু বিষয় সংযুক্ত করেছি। এই আইনের আওতায় জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি নামে নতুন একটি সংস্থা হবে যাদের কাজ হবে সাইবার সংক্রান্ত অপরাধগুলোকে চিহ্নিত করা এবং এই অপরাধগুলোর জন্য শাস্তির মাত্রা ঠিক করা। আগের আইনের কাঠামোয় অ-জামিনযোগ্য ধারা থাকলেও সেগুলো নতুন আইনে বেশিরভাগই জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ ধারা এখনো অ-জামিনযোগ্য রয়েছে। এসব ধারার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরণের প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা, সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংগঠন, আইনানুগ কর্তৃত্ব বহির্ভূত ই-ট্রানজেকশন, বে-আইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ ও স্থানান্তর ইত্যাদি। নতুন আইনে কারাদণ্ডের পরিবর্তে জরিমানার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আগের আইনে জেলের উপর ফোকাসটা বেশি ছিল। এখানে এসে জেলের সাজার পরিমাণটা কমানো হয়েছে। কিন্তু আবার আর্থিক জরিমানা বৃদ্ধি করা হইছে। এটা যখনই কার্যকর হবে তখন আগের আইনটি রহিত হয়ে যাবে।

কতটা গুণগত পরিবর্তন হবে?
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে নতুন যে আইনটি আসবে সেটি আসলে গুণগত কোন পরিবর্তন আনবে না। আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, দুই-একটা ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ কমানো হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ শাস্তির বিধান রদ করা হয়েছে। তবে এতে, এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার ব্যক্তিদের আশাবাদী হওয়ার মতো কোন বিষয় নেই। যাদের আগে সাত বছর জেল হতো এখন তার তিন বছর জেল হবে, এটা মনে করে তো খুব বেশি পুলকিত হওয়ার জায়গা আমি দেখছি না।  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল আপত্তির জায়গাগুলোতে কোন পরিবর্তন আসেনি। বিশেষ করে তিনি এই আইনে ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করা বা অনুভূতিতে আঘাতের মতো বিষয়গুলো ফৌজদারি আইনে অপরাধ হিসেবে অন্যান্য দেশে প্রায় শত বছর আগে উঠে গেলেও সেগুলো এখনো বাংলাদেশে চর্চিত হচ্ছে। ফৌজদারি আইনের আওতায় অপরাধ হচ্ছে যেসব ক্ষতি দেখতে, জানতে ও বুঝতে পারা যায় সেগুলো। আর যেসব অপরাধের ক্ষতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয় সেগুলো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় থাকা উচিত নয়। যেমন- ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করা, ‘অবমাননা’ বা ‘মানহানি’ ইত্যাদি। ‘অবমাননা’ আর ‘মানহানি’র মতো বিষয়গুলো দেওয়ানি আইনে মামলা হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেওয়ানি ক্ষতির ব্যাপারগুলো আমরা ফৌজদারি আইনে নিয়ে এসে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করছি। মূল আপত্তি হলো ওই জায়গায়। ওই জায়গাগুলোতে কোন পরিবর্তন হয়নি। মানহানির মামলা ফৌজদারি আইনে করা হলে তাতে যে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে তা ওই ব্যক্তি পাবে না, বরং সেটা পাবে রাষ্ট্র। আর এই একই মামলা দেওয়ানি আইনে করা হলে ক্ষতিপূরণ পাবে ব্যক্তি। মানহানি হলো আমার, আর ক্ষতিপূরণ পেলো রাষ্ট্র- এটা তো ন্যায় বিচার হলো না।

মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রতিস্থাপন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করার মানে এই নয় যে,এটা নিবর্তনমূলক হবে না, কারণ পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের মতো বিষয়টি এই আইনেও রয়ে গেছে। ডিজিটার নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই ধারাটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তার কোন পরোয়ানা ছাড়াই সেখানে তল্লাসি, সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাসি, এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের এখতিয়ার রয়েছে। বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার- এটা কিন্তু যেকোন মানুষকে হেনস্তা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজে লাগাতে পারে। মানহানির ক্ষেত্রে ডিএসএ এর ২৯ ধারায় যে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ছিল সেটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর পরিবর্তে জরিমানার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থদণ্ডের যে পরিমাণটা দিয়েছে সেটা বাংলাদেশের কতজন মানুষ দিতে পারবে? যাদের অর্থ দেয়ার সামর্থ্য আছে তারা অর্থ দিয়ে আইনের ধারা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। আর যাদের অর্থ নেই তাদের কারাবাস করতে হবে। ফলে আইনটি সবার ক্ষেত্রে সমপ্রয়োগের সুযোগ কম।

জরিমানার পরিমাণ বেশি করার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, অপরাধকে নিরুৎসাহিত করার জন্যই এমন ধারা রাখা হয়েছে। অপরাধ যিনি করেন না তাকে তো জরিমানা করা হবে না। আইন আমরা করি যাতে অপরাধী দ্বিতীয়বার আর এই অপরাধ না করে সংশোধন হয়। আর যদি মনে করেন যে, অপরাধ করার পরে এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে দ্বিতীয়বার আবার করতে পারবে, সে সুযোগ দেয়ার জন্য তো আইন করা হয় নাই। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই এই আইনটি করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই আইসিটি ক্ষেত্রে যে ব্যাপ্তি, যে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে, নতুন নতুন অপরাধের প্রবণতা আসছে, সেগুলো পর্যালোচনা করেই এই আইন করা হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, এ ধরণের আইনের পরিবর্তন আনার আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে আলোচনা করা উচিত ছিল যেটি সরকার করেনি। বিশেষ করে যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভূক্তভোগী ছিলেন, যেসব পেশাজীবী এই আইনের শিকার হয়েছেন তাদের সাথে কথা বলা উচিত ছিল বলে মনে করেন তারা।

প্রযুক্তি নিয়ে এ পর্যন্ত যত আইন
তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয় যেটি আইসিটি আইন হিসেবে পরিচিত পায়। সেই আইনে বলা হয়, বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা দেয়া এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়। ২০১৬ সালে এই আইনটি সংশোধন করে আরো কঠোর করা হয়। এই আইনের অধীনে বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি বাড়ানো হয়। আইসিটি অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর থেকেই এই আইনটির বিভিন্ন ধারা নিয়ে বির্তক তৈরি হয়। বিশেষ করে আইনটির ৫৭ ধারা বাতিলের তুমুল দাবি ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে এটি খসড়াটি সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন এই আইনে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল করে তার পরিবর্তে এসব ধারার অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হয়। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি বাতিল হয়ে যায়নি।

শাহদীন মালিক বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা বিষয়ক। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে কম্পিউটার ব্যবহার করে করা অপরাধ বিষয়ক। ফলে দুটোই আইনই বহাল রয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি রহিত হয়ে যাবে বলে জানানো হয়। রহিত করার মানে হলো, যেদিন থেকে নতুন আইন কার্যকর হবে সেদিন থেকেই আগের আইনটিতে আর কোন মামলা হবে না। নতুন অপরাধের জন্য নতুন আইনে মামলা ও বিচার হবে। তবে আইন রহিত করা মানে সেই আইনটি বাতিল করা নয় বরং হেফাজত করা হয়। হেফাজত করার মানে হচ্ছে পুরনো আইনের অধীনে যে মামলাগুলো শুরু হয়েছে সেই মামলাগুলোর জন্য পুরনো আইন বহাল থাকবে। ওই মামলাগুলোর জন্য ওই আইন এখনো জীবিত আছে, সেগুলোর বিচার ওই আইন অনুযায়ীই হবে।