| |
               

মূল পাতা রাজনীতি বিএনপি ঢাকার সমাবেশ থেকে বিএনপি কী অর্জন করলো?


বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ঢাকার সমাবেশ থেকে বিএনপি কী অর্জন করলো?


রহমত নিউজ ডেস্ক     01 August, 2023     12:06 PM    


নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বাংলাদেশে গত এক বছর ধরেই বেশ জোরেশোরে আন্দোলন শুরু করেছে অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো। তারা এই আন্দোলনকে বলছে যুগপৎ আন্দোলন, অর্থাৎ আলাদাভাবে হলেও এক লক্ষ্যে আন্দোলন করছে। এই সপ্তাহেই বিএনপি তিনদিনে বড় আকারের তিনটি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছে। গত শুক্রবার ২৮ জুলাই ঢাকায় তারা একটি মহাসমাবেশ করেছে। এর পরদিন ঢাকার প্রবেশপথ গুলোয় অবস্থান কর্মসূচী পালন করে বিএনপি, যেখানে কয়েকটি স্থানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সমাবেশে বিপুল উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছে, যাতে দেশের মানুষ এবং বিদেশিদের কাছে বিএনপির জনসমর্থনের বিষয়টি তুলে ধরা যায়।এসব আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কী অর্জন করতে পারছে? নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ সরকারের যে দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে, তাতে দেশে বড় ধরনের গণজোয়ার তৈরি না হলে অথবা আন্তর্জাতিকভাবে বড় চাপ না এলে সরকারের অবস্থান পরিবর্তন হবে না। বিএনপিও সেটা উপলব্ধি করতে পারছে। এই কারণে অব্যাহত সভা-সমাবেশে নিজেদের বড় উপস্থিতি জাহির করে তারা সেই দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। এতে একদিকে তারা যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে, তেমনি দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে গিয়ে সরকারও কঠোর কোন ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে না।

গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি তো আসলে তাদের শক্তির একটা মহড়া দিচ্ছে। তাদের লাগাতার যেসব কর্মসূচী আমরা দেখছি, এর মাধ্যমে তারা দেখানোর চেষ্টা করছে যে, তারা অনেক বড় একটা রাজনৈতিক দল, তাদের আন্দোলনের পেছনে মানুষের সমর্থন রয়েছে। এটার গতি বেড়েছে ইদানীং, কারণ নির্বাচন কাছাকাছি চলে এসেছে। এতদিন আমরা দেখেছি, তাদের সমাবেশের ওপর নানারকম বাধানিষেধ থাকতো, পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা থাকতো। এখন মনে হচ্ছে, সেই বাধা অনেক কমেছে। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সেটা হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণেও হতে পারে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলন দেখা গেছে, প্রায় ১০ বছর আগে. ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে। সেই সময় বিরোধী দলগুলো দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। যদিও যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ-বোমা নিক্ষেপের দায়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েছিল সেই আন্দোলন। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর থেকেই অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল বিএনপি এবং অন্য সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এজন্য মামলা, গ্রেপ্তার এবং সরকারের দমন নীতিকেও দায়ী করা হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। গত বছর থেকে এসব দলকে অনেকটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাগিদ দেয়া, নির্বাচনে বাধা দানকারীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক পাঠানো-না পাঠানো নিয়ে যাচাই-বাছাই এবং বিদেশি আরও কয়েকটি দূতাবাসের নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্যের পর এটা পরিষ্কার যে, আগামী নির্বাচনের দিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে সারা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই নিজেদের দাবি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য একের পর এক কর্মসূচী নিয়েছে বিএনপি।

'জনসমর্থন' এবং ‘দল হিসেবে গুরুত্ব’
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বিএনপি দেশের মানুষের সামনে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের নিজেদের জনসমর্থন এবং রাজনৈতিক দল হিসাবে গুরুত্বের বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিল, এসব সমাবেশের মাধ্যমে তারা সেটা ভালোভাবেই করতে পেরেছে।

গত বছরের শেষের দিকে বিভাগীয় শহরগুলোয় সমাবেশের পর ডিসেম্বরে ঢাকায় বড় আকারের একটি সমাবেশ করে ১০ দফা ঘোষণা করেছিল বিএনপি, যার মধ্যে প্রধান দাবী ছিল নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গত শুক্রবার মহা সমাবেশে করেছিল বিএনপি। সেখান থেকে সরকারের পদত্যাগ, সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইত্যাদি দাবিতে শনিবার ঢাকার সব প্রবেশ মুখে অবস্থান কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। সোমবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন চাই না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। সোজা কথায় না হলে ফয়সালা হবে রাজপথে। আমরা বহুদূর এগিয়ে গেছি। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘তাদের পক্ষে যে একটা সমর্থন আছে, সেটা তারা কিছুটা হলেও দেখাতে পেরেছে। আমার কাছে মনে হয়, একই সাথে তারা হয়তো এটাও দেখতে চাইছে, সরকার বিরোধীদের এই রাজপথে নামাকে কীভাবে ট্যাকল করে। নির্বাচনের বছরে আশা করা ঠিক হবে না, রাজনৈতিক দলগুলো স্কুলের ছাত্রদের মতো আচরণ করবে। অগাস্ট মাস কতটা হবে আমি জানি না, কিন্তু সেপ্টেম্বর, অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে এরকম শো-ডাউন আমরা দেখতে থাকবো।

সরকার দেখাতে চায় দেশে ‘রাজনৈতিক পরিবেশ আছে’
এর মধ্যে নিজেদের সব অঙ্গ এবং সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগও ঘোষণা করেছে, তারাও রাজপথ দখলে রাখবে। বিএনপি যেসব সমাবেশ বা কর্মসূচী দিয়েছে, তাদেরও পাল্টা কর্মসূচী দিতে দেখা গেছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যাতে কোন সহিংসতা তৈরি না হয়, সেজন্য উভয় দলই সতর্ক দূরত্ব রেখেছে। শান্তনু মজুমদার বলেন, আসলে পুরো পরিস্থিতি দুই দলের জন্যই সমান সমান বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। বিএনপির যে জনসমর্থন আছে, সেটা তারা সবার কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। সেই সঙ্গে সরকারও এটা প্রমাণ করতে পেরেছে যে দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ আছে, তারা বিরোধীদের কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে না। সরকারের এটাই স্বাভাবিক আচরণ হওয়া উচিত যে, বিরোধীরা যেন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে, মত প্রকাশ করতে পারে। সেই সঙ্গে বিরোধীদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। তারা আন্দোলন করবে, মিছিল করবে, দাবি জানাবে, কিন্তু সেখানে যাতে সহিংসতা না হয়, জন ভোগান্তি না হয়, সেটাও তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। ২০১৩ বা ২০১৪ সালে যা হয়েছে, দশ বছর পরে এসে আমরা আর কেউ সেই অতীতের দিকে যেতে চাই না।

সাংগঠনিক শক্তিও ‘দেখাতে পেরেছে বিএনপি’
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক বছর ধরে একের পর এক সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি এটা প্রমাণ করে দিয়েছে, এতদিন ধরে নিশ্চুপ থাকলেও তাদের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়নি। যে কারণে তারা বেশ ভালোভাবে জেলায়, বিভাগে বা ঢাকায় কোন ঝামেলা ছাড়াই বড় আকারের সমাবেশ করতে পেরেছে। এটা তাদের দলের কর্মীদের আরও চাঙ্গা করে তুলছে। সহিংসতা না হলে এ ধরনের আন্দোলনকে স্বাগত জানানোই উচিত, তাতে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সুস্থতা প্রমাণ করে। তবে সেটা ছুটির দিনে হলে জন দুর্ভোগ অনেক কমে যায়, সেটাও দলগুলোর বিবেচনায় রাখা উচিত।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, অতীতের তুলনায় গত বছর বা এই বছরে বিএনপির সমাবেশগুলো বেশ শান্তিপূর্ণ দেখা যাচ্ছে। আগে যেমন দেখা যেতো, ভাঙচুর, নিজেদের মধ্যে মারামারি, সেটা এবার দেখা যাচ্ছে না। ফলে তারা দলীয় একটি সংহতিও দেখাতে পারছে। ফলে যারা মনে করতেন, দলগতভাবে বিএনপি ভঙ্গুর হয়ে গেছে বা দুর্বল হয়ে গেছে, এসব সমাবেশের মাধ্যমে তাদের সামনে তারা নিজেদের দলীয় শক্তির প্রমাণ দিচ্ছে। জন ভোগান্তি হচ্ছে প্রচুর, কিন্তু দলগতভাবে তারা সাংগঠনিক শক্তি প্রমাণ করতে পারছে। রাজপথে শক্তির মহড়া দেখানোর যে খেলা আমরা রাজনীতিতে দেখি, বিএনপির পক্ষ থেকে সেটা ক্রমাগত বাড়ছে।