| |
               

মূল পাতা জাতীয় অর্থনীতি অর্থনীতিবিদরা বাজেটের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখছেন


অর্থনীতিবিদরা বাজেটের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখছেন


রহমত নিউজ ডেস্ক     27 June, 2023     10:09 AM    


বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পাশ হয়েছে। দেশটির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই বাজেটের বাস্তবায়ন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে? সোমবার (২৬ জুন) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৭ লাখ কোটির বড় বাজেট অনুমোদন করা হয়েছে। সবমিলিয়ে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এর চেয়ে বড় আকারের বাজেট আর পাশ হয়নি। কিন্তু বৃহৎ এই বাজেট পাশ হলো এমন সময় যখন করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব জুড়েই মন্দা চলছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছে। ডলার সংকট, আমদানিতে কড়াকড়ি আর আইএমএফের শর্তের প্রভাবে এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। সেখানে বৃহৎ এই বাজেটের বাস্তবায়ন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে?

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে উঠতে পারে
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ বছরের বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে রাজস্ব আয়।

বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়, মুনাফা বা মূলধনের ওপর কর, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক- ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, স্ট্যাম্প বিক্রয়-ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। আর লভ্যাংশ ও মুনাফা, সুদ, জরিমানা, দণ্ড, সেবা বাবদ প্রাপ্তি, ভাড়া ও ইজারা, টোল, অন্যান্য রাজস্ব প্রাপ্তি- ইত্যাদি থেকে আয় ৫০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আয়ের যে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আদায় করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতা, যেটা দীর্ঘদিন ধরে আরও বাড়ছে, সেটাই এই বাজেটের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে বাজেটের বিভিন্ন খাতে অর্থায়ন কীভাবে করা হবে, সেটাও একটা বিষয় হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে সরকারের সামনে সহজ সমাধান টাকা ছাপানো। কিন্তু তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। কারণ এতে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হবে, বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে দেবে।’টাকা না ছাপিয়ে কীভাবে সরকার এই অর্থায়ন করবে, আদৌ করতে পারবে কিনা, সেটাই আসলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় করা অর্থের পরিমাণ ক্রমে ৬৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতি ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব না। বিদেশি ঋণ ১০ বিলিয়ন ধরা হয়েছে - যা পুরোপুরি আসবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। সেটা এলেও অভ্যন্তরীণ খাত থেকে দেড় লক্ষ্য কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে, আর তা বর্তমান নাজুক ব্যাংকিং খাতের ওপর আরও চাপ তৈরি করবে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের গত একযুগের বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেখানে বড় বড় লক্ষ্য ঠিক করা হলেও, বছর শেষে তা অর্জন করা সম্ভব হয়না। ফলে পরবর্তীতে বাজেটে বেশ কাটছাঁট করা হয়।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা
ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা মিজানুর রহমান তার পরিবারের জন্য একবছর আগে তার পরিবারের জন্য মাসে যে পরিমাণ টাকা খরচ করতেন, এখন তার চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়। কিন্তু আগের চেয়ে অনেক কষ্টে তাকে সংসার চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে। আগে সপ্তাহে পাঁচদিন মাছ-মাংস রান্না হতো, এখন সেটা দুইদিনে নামিয়ে এনেছি। বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎবিল, পানির বিল, যাতায়াত খরচ সব বেড়েছে, তার সাথে তাল রেখে আমার বেতন তো বাড়েনি। সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘’আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। সেটা করতে হলে সুদের হার অনেক বাড়াতে হবে। সেটা করবে কিনা আমি জানি না। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা আছে। সরকার কতটা কী করে, এটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।‘’

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। মহামারির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে পরপর দুই বছর অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল, সেটা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে গত একবছর ধরেই আমদানিকে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। কিন্তু তার ফলে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্য পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বিবিসি বাংলাকে বলেন,‘’অর্থনীতির যে গভীর সমস্যা চলছে, সেসব সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগ এই বাজেটে নেয়া হয়নি। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, যা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে। কিন্তু এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।‘’

প্রবৃদ্ধি অর্জন করা
বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। কিন্তু সেটি অর্জনের কোন সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘’এ বছর বাজেটে যে সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, সেটা অর্জন করা সম্ভব নয়, সেটা হবে না। হয়তো ছয়ও হবে না। আমাদের বাস্তবসম্মত হতে হবে।‘’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখানে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এক বছরে জিডিপির অনুপাতে ৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসে এরকম কোন উদাহরণ নেই, এমনকি গত এক দশকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ১ শতাংশের বেশি বাড়েনি। ফলে এসব অনুমিতিগুলোই যথেষ্ট দুর্বল বলে তারা মনে করছেন।

অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ‘’সরকারের উচিত ছিল এই মুহূর্তে অর্থনীতি যে সংকটে আছে, সেখান থেকে বের করে আনা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেয়া। কিন্তু সরকার যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করেছে, সেটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়েছে।‘’

পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের উচিত বাজেটের অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলা। কিন্তু বেতন-ভাতা, ভর্তুকি দেয়া, প্রশাসনিক খরচের মতো অনেক ক্ষেত্রে সরকারের আসলে হাত বাঁধা, তাকে সেটা খরচ না করে উপায় নেই। ফলে সরকার যদি বাজেট কিছুটা ছেঁটে না ফেলতে পারে, আর রাজস্ব থেকে বা বিদেশি ঋণ থেকে যদি পরিকল্পনা মাফিক অর্থ না আসে, তাহলে তো সরকারের সামনে বিশাল অংকের টাকা ছাপানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সেটি ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সক্ষমতায় ঘাটতি
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশাল আকারের বাজেট দেয়া হলেও তার বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের পুরো সক্ষমতা তৈরি হয়নি। এই কারণে প্রতিবছরে বাজেটে যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, অনেক দপ্তর সেগুলো পুরোপুরি খরচ করতে পারে না। অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলছেন, ‘’এই যে বিশাল বাজেটের কথা বলা হচ্ছে, সেটা বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয় বা দপ্তরগুলো প্রস্তুত কিনা? এতো বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, তাদের যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তারা সেটাই পুরোপুরি খরচ করতে পারে না। এবার বর্ধিত বরাদ্দ দিলেও কি তারা খরচ করতে পারবে? বাজেটের জন্য এটি বড় একটি চ্যালেঞ্জ।’গত এক দশকের বাজেট বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, বাজেটে আসলে তিনটা ঘটনা ঘটে। প্রথমে একটা প্রস্তাবিত বাজেট, এর ছয়মাস পরে একটা রিভাইজড বাজেট আমরা দেখি, তার ছয়মাস পরে আমরা একটা অ্যাকচুয়াল বাজেট দেখি। প্রস্তাবিত বাজেটের সাথে অ্যাকচুয়াল বাজেটের তুলনা করলে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটের ৭৭ থেকে ৭৮ ভাগ খরচ করা গেছে। তার মানে বড় একটা পরিমাণ খরচ করা যায় না। এর দুইটা কারণ। রাজস্ব আদায় ঠিকমতো হয় না, আরেকটি হলো মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা কম। বাজেটের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে এর কারণ খুঁজে বের করে সমাধানের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতির দুরবস্থা কাটাতে কী এনেছে বাজেট?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে আয়-ব্যয়ের যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সফলভাবে সেগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করে অর্থনীতির অনেকগুলো ভিত্তির ওপরে। কিন্তু বর্তমান সংকটে সেসব উপাদান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাজেটে তার সমাধানে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘’সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির বেশ কিছু জায়গায় আমাদের অনেক সমস্যা আছে। বিশেষ করে আর্থিক খাত, ব্যাংকিং খাতে অনেক সংস্কার দরকার। কিন্তু বাজেটে সেই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কি কোন সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে? আসলে বর্তমান সময়ের যে, দাবি, সেগুলোকে অ্যাড্রেস বাজেটে দেখা যাচ্ছে না।‘’

ঋণ দেয়ার শর্ত হিসাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তার কিছু কিছু এর মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হয়ে গেছে। যেমন তেলের দাম, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, অনেক খাতে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ছয় মাসের মুদ্রানীতিতে তার কিছু প্রতিফলন দেখা গেছে। তবে কর খাতে, ব্যাংকিং খাতের, পুঁজি বাজারের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সংস্কারগুলো এ বছরের বাজেটেও আলাদা কোন গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশে যেসব বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলো পরিশোধের চাপ তৈরি হবে। সেটা সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নতুন করে চাপ তৈরি করবে। সেজন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, সেটা দেখা যায়নি এই বছরের বাজেটে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা