| |
               

মূল পাতা ইসলাম ‘নব্য আহলে কুরআনের’ মূল অপরাধ রাসূল অবমাননা


‘নব্য আহলে কুরআনের’ মূল অপরাধ রাসূল অবমাননা


মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক     22 May, 2023     09:24 AM    


الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلاالله وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد!

প্রেক্ষাপট
‘আহলুল কুরআন’ মূলত একটি মর্যাদাপূর্ণ দ্বীনী পরিভাষা। ‘নব্য আহলে কুরআনেরা’ এটিকে নিজেদের জন্য অন্যায়ভাবে ব্যবহার করছে। আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إن لله أهلينَ من الناس.

‘নিশ্চয়ই মানুষদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর‘আহল’ (অর্থাৎ আল্লাহর বিশেষ ব্যক্তি)।’

সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন-

يا رسول الله من هم؟

‘হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা?’

আল্লাহর রাসূল বললেন-

هم أهل القرآن، أهل الله وخاصّته

‘তারা আহলুল কুরআন-কুরআনওয়ালা। তারাই আল্লাহর ‘আহল এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজন।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১২২৭৯; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৭৯৭৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৫

কারা এই কুরআনওয়ালা, যারা আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন?

উত্তর স্পষ্ট, সবচে বড় কুরআনওয়ালা হলেন স্বয়ং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর উপর আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন। তাঁকে কুরআন তিলাওয়াত এবং কুরআনের ব্যাখ্যা ও তাফসীর শিখিয়েছেন। তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন- তিনি যেন মানুষকে কুরআনের তিলাওয়াত শেখান, কুরআনের অর্থ-মর্ম ও বিধি-বিধান শেখান, তাদের সামনে কুরআনী জীবনের বাস্তব নমুনা পেশ করেন, কুরআনে নির্দেশিত ইবাদতসমূহের পদ্ধতি ও পরিপূর্ণ রূপরেখা শেখান এবং তাদেরকে কুরআনী শরীয়ত (যা নবীজীর সুন্নতও বটে) শিক্ষা দেন।

এরপর মানুষের উপর ফরয করেছেন- এই সকল বিষয়ে তারা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করে, তাঁর অনুসরণ করে এবং তাঁর জীবন থেকে নিজেদের জীবনের আদর্শ গ্রহণ করে। সঙ্গে কুরআনে এই সাক্ষ্যও দিয়ে দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে কুরআন এবং তাতে নির্দেশিত সিরাতে মুসতাকীমেরই পথ দেখান। কুরআনী নূরের মাধ্যমেই তিনি মানুষকে ভ্রষ্টতা ও মূর্খতার অন্ধকার থেকে হেদায়েত ও ইলমের আলোর দিকে নিয়ে যান।

অতএব খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বপ্রথম ও সবচে বড় ‘আহলুল কুরআন’ বা কুরআনওয়ালা। দ্বিতীয় পর্যায়ের আহলুল কুরআন হলেন সাহাবায়ে কেরাম। সাহাবায়ে কেরামকে আল্লাহ তাআলা কুরআনের সর্বপ্রথম তালিবে ইলম হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন। তাঁদেরকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁর উপর এই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআন সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে মানদণ্ড বানিয়েছেন। যেমন কুরআনের প্রতি ঈমান, কুরআনের ‘পাঠ’ ও তার তিলাওয়াত, কুরআন অনুধাবন, কুরআনের ব্যাখ্যা, কুরআন অনুযায়ী আমল ইত্যাদি। আর এই মহান আমানতের প্রথম বহনকারী ও প্রথম সাক্ষ্যদানকারী বানিয়েছেন সাহাবায়ে কেরামকে। পরবর্তীদেরকে কুরআন হাসিলের ক্ষেত্রে তাঁদের মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন। এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত ও শিক্ষা ছেড়ে কুরআনের প্রতি ঈমান আনাই অসম্ভব।

আর সাহাবায়ে কেরামকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কুরআনী যিন্দেগীর উপর রেখে গিয়েছেন সেটাই ‘সাবীলুল মুমিনীন’-মুমিনদের পথ। মুমিনদের পথ থেকে বিমুখ হওয়া আল্লাহ তাআলার নিকট এমন অপরাধ, যেমন অপরাধ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করা। এই দুই অপরাধের একই শাস্তি আর সেটা হল জাহান্নাম।

‘আহলে কুরআন’ নামধারীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে -নাউযুবিল্লাহ- ডাকপিয়নের মত মনে করে। ডাকপিয়ন পত্র পৌঁছে দিলেই তার কাজ শেষ। তাদের কাছে রাসূলুল্লাহর কাজটিও যেন এমনই। অর্থাৎ রাসূলের দায়িত্ব ছিল কেবল কুরআন পৌঁছে দেওয়া। তিনি পৌঁছে দিয়েছেন; ব্যস, তাঁর কাজ শেষ। এখন কুরআন বোঝা, তদনুযায়ী কুরআনী ও ঈমানী জীবনের রূপরেখা তৈরি করা, তা থেকে আল্লাহর নির্দেশনাবলি ও বিধানাবলি উদ্ঘাটন করা, তাতে ফরযকৃত ইবাদতসমূহ আদায়ের পদ্ধতি নির্ধারণ করা- এই সব কাজ আমাদের!! নাউযুবিল্লাহ।

অতএব নব্য আহলে কুরআনের পরিচয় হল, তারা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহর চাইতে অধিক কুরআন অনুধাবনকারী ও অনুসরণকারী এবং কুরআনওয়ালা মনে করে। শুধু এটুকু নয়; তারা যেন এটাও বলতে চায় যে, ‘কেবল আমরাই কুরআন বুঝি এবং কুরআন মানি।’ সেজন্য তাদের শ্লোগান হল, ‘রাসূলের হাদীস, সুন্নত, সীরাত নয়; মানব শুধু কুরআন’। স্পষ্ট, এটা রাসূলের প্রতি চরম অবমননা।

এ ধরনের অবমাননার অর্থ হল, তাদের না আছে রাসূলের প্রতি ঈমান ও নির্ভরতা, না আছে কুরআনের প্রতি ঈমান। এর অনিবার্য ফল হল, আল্লাহ তাআলার নিকট তাদের কুরআন মানাই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কুরআনের প্রতি ঈমান ও কুরআন অনুযায়ী আমলের যে পন্থা ও মাপকাঠি আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেটার প্রতি তাদের আস্থা নেই। তাদের আস্থা কেবল নিজেদের বুঝ ও পছন্দের প্রতি।

এই নব্য আহলে কুরআনের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মুসলিম উম্মাহর প্রথম শতাব্দীতে যে মুনাফিকরা ছিল, তারা কখনো কখনো প্রশ্ন ওঠাত, এই হাদীস কুরআনের কোথায় আছে? যাদের ঈমান ও ইলম তখনো পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি, হয়ত তাদের কেউ কেউ সে প্রশ্ন কোনো সাহাবী বা কোনো তাবেয়ীর সামনে রাখত। তখন তাঁরা তাদের সংশয় কীভাবে দূর করতেন সেটাও ইতিহাসে সংরক্ষিত রয়েছে। কোনো সুযোগে তা পাঠকবর্গের সামনে পেশ করব- ইনশাআল্লাহ।

আমরা কম মানুষই হয়ত জানি, নব্য আহলে কুরআনের এসব কুফরী চিন্তা-ধারার প্রচার-প্রসার এখন আমাদের দেশে, এমনকি আমাদের রাজধানীতেই চলছে। প্রয়োজন সতর্কতা ও বিচক্ষণতা। মুমিনের জন্য ঈমান সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই সম্পদ হেফাযত করা ফরয। সর্তক থাকতে হবে, কখন কে এই সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চলে আসে।

এই প্রেক্ষাপট এবং সহমর্মিতা ও কল্যাণকামিতার ভিত্তিতেই বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি প্রস্তুত হয়েছে। অধমের কথাগুলোকে প্রবন্ধের রূপ দিয়েছেন মওলবী মাহমূদ বিন ইমরান। আল্লাহ তাআলা তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন এবং তার এই মেহনতকে কবুল করুন। আমাদের সবাইকে কবুল করুন এবং এ থেকে পুরোপুরি উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন।

-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

২৭ সফর ১৪৪২ হি.


ঈমান ও ইসলাম আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। আমরা তাঁর শোকর আদায় করি, তিনি আমাদের মুমিন ও মুসলিম বানিয়েছেন। হেদায়েত ও পথনিদের্শনার জন্য দান করেছেন কুরআনে কারীম। এটি নাযিল করেছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। তিনি বলেন-

و َ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الذِّكْرَ لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیْهِمْ وَ لَعَلَّهُمْ یَتَفَكَّرُوْنَ.

(হে নবী!) আমি আপনার প্রতি ‘আযযিকর’  নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে সেইসব বিষয়ের ব্যাখ্যা করে দেন, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। -সূরা নাহল (১৬) : ৪৪

‘আযযিকর’ কুরআনে কারীমের একটি নাম। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমি আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি, যেন আপনি তা মানুষকে খুলে খুলে বুঝিয়ে দেন। আর তারাও যেন চিন্তা-ভাবনা করে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বুঝিয়ে দেবেন, সে আলোকেই তারা চিন্তা-ভাবনা করবে। এতে কুরআনের শিক্ষাগুলো তাদের অন্তরে স্থির হয়ে যাবে এবং আমলে এসে যাবে। লক্ষণীয় হল, আল্লাহ তাআলা কুরআন অবতীর্ণ করে তার বয়ান ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। অর্থাৎ কুরআনে কারীমের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করবেন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

মুমিন হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত রাসূলের প্রতি ঈমান

মুমিন হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনা।

কেউ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান না আনে, সে মুমিন নয়। তাই আল্লাহর প্রতি যেমন ঈমান আনতে হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও ঈমান আনতে হবে। সেইসঙ্গে আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি যে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন তার প্রতিও ঈমান আনতে হবে। কুরআন মাজীদে তিনি বলেন-

اٰمَنَ الرَّسُوْلُ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِ مِنْ رَّبِّهٖ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلٌّ اٰمَنَ بِاللهِ وَ مَلٰٓىِٕكَتِهٖ وَ كُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ  لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْ رُّسُلِهٖ.

রাসূল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছেন, যা তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তারা সকলে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না (যে, কারো প্রতি ঈমান আনব আর কারো প্রতি ঈমান আনব না।) -সূরা বাকারা (২) : ২৮৫

এ আয়াতে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর নাযিলকৃত কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ঈমান, কিতাবের প্রতি ঈমান, ফিরিশতা ও নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান- এগুলোর কী অর্থ সেটা আমাদের ভালোভাবে জানতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কুরআনে কারীমের প্রতি ঈমান আনার কী অর্থ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনার কী অর্থ?

রাসূলের প্রতি ঈমান আনার অর্থ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হল-

এক. বিশ্বাস করা, তিনি আল্লাহর নবী ও রাসূল। এই সাক্ষ্য দেয়া-

أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ.

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।

দুই. এই বিশ্বাস রাখা, তিনি সর্বশেষ নবী। খাতামুন নাবিয়্যীন। তাঁর পরে আর কেউ নবী হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ  وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا.

মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০

স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَنَا خَاتَمُ النّبيِّينَ، لَا نَبِيّ بَعْدِي.

আমি সর্বশেষ নবী। আমার পর কোনো নবী নেই। (অর্থাৎ আমার পরে নতুন করে কেউ নবী হবে না।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৫৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৮৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৫২; জামে তিরমিযী, হাদীস ২২১৯

قال الترمذي: هذا حديث صحيح.

সুতরাং রাসূলুল্লাহর পর কেউ যদি নিজেকে নবী দাবি করে, সে মিথ্যাবাদী এবং কাফের। তেমনিভাবে যারা এই মিথ্যানবীকে নবী বা মুজাদ্দিদ, মাহদী বা মাসীহ কিংবা তার অনুরূপ, অথবা ঈমানদার নেককার মনে করবে তারা সবাই কাফের। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে নবী দাবি করেছিল। তাকে অনেকে গ্রহণও করে নিয়েছে। এরা সবাই কাফের।

কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে আর কেউ নবী বা রাসূল হবে না। কাজেই তাঁর পরে কেউ যদি নিজেকে নবী দাবি করে, প্রথমত সে মিথ্যাবাদী। কারণ কেউ নিজের ইচ্ছেমতো নবী হতে পারে না। নবী তো মনোনীত করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনিই ঘোষণা করেছেন, সর্বশেষ নবী হলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতএব এখন যদি কেউ নবুওত দাবি করে, সে মিথ্যাবাদী।

দ্বিতীয়ত সে কুরআন অস্বীকারকারী। কুরআনের সুস্পষ্ট ও অকাট্য হুকুম অস্বীকারকারী। তাই সে কাফের এবং তাকে যারা অনুসরণ করছে তারাও কাফের।

মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীরা ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাত’ নামে পরিচিত। এ দেশেও তার অনুসারী রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এতকিছুর পরেও তারা নিজেদের মুসলিম বলে প্রকাশ করে। এটা একেবারে স্পষ্ট ধোঁকাবাজি।

মিশরে ডক্টর রাশাদ খলীফা নামে এক ব্যক্তি আছে। সেও নিজেকে নবী দাবি করেছে! ‘আহলে কুরআন’ নামে এক ফেরকা আছে। এদের আবার অনেক ফেরকা। তাদের এক ফেরকা বলে, নামায নাকি দুই ওয়াক্ত। আরেক ফেরকা বলে, তিন ওয়াক্ত। তাদের আরো অনেক ফেরকা রয়েছে। আহলে কুরআনের অনেকে রাশাদ খলীফাকে নবী মানে- নাউযুবিল্লাহ।

তিন. এটাও বিশ্বাস করা যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা যেসকল দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন সেগুলোর প্রত্যেকটি তিনি যথাযথ আদায় করেছেন। তাঁর সে দায়িত্বগুলোর বিবরণ কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। এই সকল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যা করেছেন এবং যা বলেছেন সবকিছু বিশ্বাস করা এবং মনেপ্রাণে মেনে নেওয়া তাঁর প্রতি ঈমানের অংশ। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত এইসব দায়িত্ব পালনার্থে যা বলেছেন বা করেছেন সেটাই হাদীস ও সুন্নাহ। কুরআনের ভাষায় ‘হিকমাহ’ ও ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ’। সেটা গ্রহণ ও অনুসরণ করাকে কুরআন ফরয করেছে এবং  মান্য করাকে ঈমানের শর্ত সাব্যস্ত করেছে।

চার. তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভালবাসা রাখা।

পাঁচ. তাঁর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা। অবমাননা নয়; শুধু তাঁর সামান্য অসম্মান বা কষ্টের কারণ হয়, এমন সব কথা ও আচরণ থেকে বিরত থাকা।

ছয়. তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআনকে সর্বশেষ ওহী-গ্রন্থ হিসাবে মেনে নেওয়া। তাঁর শরীয়তকে আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ ইসলামী শরীয়ত হিসাবে গ্রহণ করা।

সাত. মুক্তি ও সফলতা একমাত্র তাঁর শরীয়ত ও সুন্নাহ্ অনুসরণের মাঝে- এই বিশ্বাস রাখা। এর বিকল্প খোঁজার মতো কুফরী আচরণ থেকে বেঁচে থাকা এবং এমন আচরণকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করা। তাঁর শরীয়ত ও সুন্নাহ ছেড়ে, না কোনো বিকৃত বা রহিত শরীয়তের দিকে যাওয়া যাবে, না কোনো নবআবিষ্কৃত ইজম বা মতাদর্শ গ্রহণ করা যাবে আর না নিজের খেয়াল-খুশির অনুগামী হওয়া যাবে।

এই হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান। বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের ঠিক ঠিক বোঝার তাওফীক দান করুন।

রাসূলের দায়িত্ব

বলছিলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা কুরআন দান করেছেন এবং এর মাধ্যমে তাঁকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই দায়িত্বগুলোর বিবরণ কুরআনে কারীমে বিস্তারিত আছে। তাঁর তিনটি মৌলিক দায়িত্বের কথা একত্রে কুরআন মাজীদের তিন জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। সূরা বাকারার ১২৯ সংখ্যক আয়াতে, সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ সংখ্যক আয়াতে এবং সূরা জুমুআর ২ সংখ্যক আয়াতে।

সূরা আলে ইমরানের আয়তটি হল-

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ  وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি (অতি বড়) অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। আর নিশ্চয়ই এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে ছিল। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪

এই আয়াতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে তিনটি কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা এই-

ক.     یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِه

তিনি মানুষকে আল্লাহ তাআলার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনাবেন। যাতে তাদের জন্য কুরআন মাজীদ শেখা ও মুখস্থ করা সহজ হয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে কুরআন তিলাওয়াত শিখিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম শিখিয়েছেন তাঁদের শাগরিদদের। তাঁদের বলা হয় তাবেয়ী। তাবেয়ীগণ শিখিয়েছেন তাঁদের শাগরিদদের। এভাবেই কুরআন শিক্ষার ধারাবাহিকতা এ পর্যন্ত চলে এসেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে।

খ.  وَ یُزَكِّیْهِمْ

তাদের পরিশুদ্ধ করবেন। তাদের অন্তরকে সব ধরনের আবিলতা থেকে মুক্ত করবেন। শিরক, কুফর, নেফাকসহ যাবতীয় মন্দ স্বভাব ও চিন্তা-চেতনা থেকে তাদের পবিত্র করবেন। তাদের মাঝে তৈরি করবেন সঠিক আকীদা-বিশ্বাস, সুস্থ রুচিবোধ, উত্তম চরিত্র এবং উন্নত চিন্তা-চেতনা।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় পরিশুদ্ধি লাভ করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। সেজন্য তাঁরা হলেন উম্মতের সর্বোত্তম জামাত। তাঁদের আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, রুচি-প্রকৃতি ও আখলাক-চরিত্র সবই ছিল পরিশুদ্ধ। কারণ তাঁরা তো সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবিয়ত লাভ করেছিলেন।

গ. وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ

তাদেরকে ‘কিতাব’ ও হিকমত’ শিক্ষা দেবেন। ‘কিতাব’ কুরআনেরই আরেক নাম। ‘হিকমত’ কী? তার আগে কথা হল, এই হিকমতও আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেছেন। কিতাব যেভাবে তিনি নাযিল করেছেন, হিকমতও তিনি নাযিল করেছেন। সূরা নিসায় আছে-

وَ اَنْزَلَ اللهُ عَلَیْكَ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ عَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَ كَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَیْكَ عَظِیْمًا.

আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনাকে এমন সব বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন, যা আপনি জানতেন না। বস্তুত আপনার প্রতি সর্বদাই আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে। -সূরা নিসা (৪) : ১১৩

অন্যত্র আরো বলেন-

وَّ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَیْكُمْ وَ مَاۤ اَنْزَلَ عَلَیْكُمْ مِّنَ الْكِتٰبِ وَ الْحِكْمَةِ یَعِظُكُمْ بِهٖ.

আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন এবং তোমাদেরকে উপদেশ দানের লক্ষ্যে তোমাদের প্রতি যে কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন তা স্মরণ রেখ। -সূরা বাকারা (২) : ২৩১

অতএব কিতাব ও হিকমত দুই-ই আল্লাহর নাযিলকৃত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কিতাব শিখিয়েছেন, হিকমতও শিখিয়েছেন। হিকমত হল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ এবং শরীয়তের সকল বিধি-বিধান।

সূরা জাসিয়ায় আল্লাহ তাআলা বলেন-

ثُمَّ جَعَلْنٰكَ عَلٰی شَرِیْعَةٍ مِّنَ الْاَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَ الَّذِیْنَ لَا یَعْلَمُوْنَ.

(হে রাসূল!) আমি আপনাকে দ্বীনের এক বিশেষ শরীয়তের উপর রেখেছি। সুতরাং আপনি তারই অনুসরণ করুন। আর যারা প্রকৃত জ্ঞান রাখে না, আপনি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। -সূরা জাসিয়া (৪৫) : ১৮

তিলাওয়াত শেখানো আর তা‘লীম দেওয়া- দুটো এক কথা নয়

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের তিলাওয়াত শিখিয়েছেন, আবার কুরআনের তালীমও দিয়েছেন। উভয়টাই তাঁর দায়িত্ব। প্রশ্ন হল, এই তালীম দ্বারা কী উদ্দেশ্যে? তিলাওয়াত শেখানোটাই কি তালীম? সেটা তো নয়। কারণ তিলাওয়াত শেখানোর কথা প্রথমেই রয়েছে। এরপর আছে কিতাব শিখানোর কথা। অতএব কিতাবের তিলাওয়াত শেখানো আর কিতাবের তালীম দেওয়া- দুটো এক কথা নয়। কিতাবের তালীম বলতে কী উদ্দেশ্য- সেটা কুরআনের অন্য আয়াত দ্বারা প্রতিভাত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

و َ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الذِّكْرَ لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیْهِمْ وَ لَعَلَّهُمْ یَتَفَكَّرُوْنَ.

(হে নবী!) আমি আপনার প্রতি এই কিতাব  নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে সেইসব বিষয়ের ব্যাখ্যা করে দেন, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ৪৪

অতএব কুরআনের তালীম দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কুরআনের কোন্ আয়াতের কী মর্ম, কোন্ আয়াতে কী বিধান, এবং সেই বিধান পালনের কী নিয়ম- এগুলো শিক্ষা দেওয়া।

রাসূলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করা এবং নিকৃষ্ট বস্তু হারাম করা। সূরা আ‘রাফের ১৫৭ সংখ্যক আয়াতে তার বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَلَّذِیْنَ یَتَّبِعُوْنَ الرَّسُوْلَ النَّبِیَّ الْاُمِّیَّ الَّذِیْ یَجِدُوْنَهٗ مَكْتُوْبًا عِنْدَهُمْ فِی التَّوْرٰىةِ وَ الْاِنْجِیْلِ یَاْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوْفِ وَ یَنْهٰىهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ یُحِلُّ لَهُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیْهِمُ الْخَبٰٓىِٕثَ وَ یَضَعُ عَنْهُمْ اِصْرَهُمْ وَ الْاَغْلٰلَ الَّتِیْ كَانَتْ عَلَیْهِمْ  فَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِهٖ وَ عَزَّرُوْهُ وَ نَصَرُوْهُ وَ اتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ مَعَهٗۤ  اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.

যারা এই রাসূলের অর্থাৎ উম্মী নবীর অনুসরণ করবে, যাঁর কথা তারা তাদের নিকট থাকা তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিপিবদ্ধ পাবে, যিনি তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করবেন ও মন্দ কাজে নিষেধ করবেন এবং তাদের জন্য উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করবেন ও নিকৃষ্ট বস্তু হারাম করবেন এবং তাদের থেকে ভার ও গলার বেড়ি নামাবেন, যা তাদের উপর চাপানো ছিল। সুতরাং যারা তাঁর (অর্থাৎ নবীর) প্রতি ঈমান আনবে, তাঁকে সম্মান করবে, তাঁর সাহায্য করবে এবং তাঁর সঙ্গে যে নূর অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করবে, তারাই হবে সফলকাম। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৫৭

অন্যত্র বলেন-

قَاتِلُوا الَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَ لَا بِالْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ لَا یُحَرِّمُوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ وَ رَسُوْلُهٗ وَ لَا یَدِیْنُوْنَ دِیْنَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ حَتّٰی یُعْطُوا الْجِزْیَةَ عَنْ یَّدٍ وَّ هُمْ صٰغِرُوْنَ .

কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তাকে হারাম মনে করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন বলে স্বীকার করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা হেয় হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে। -সূরা তাওবা (৯) : ২৯

এই হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম মৌলিক চারটি দায়িত্ব। মানুষকে কুরআনের তিলাওয়াত শেখানো, তাদের পরিশুদ্ধ করা, কুরআন ও হিকমত শিক্ষা দেয়া এবং উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করা ও নিকৃষ্ট বস্তু হারাম করা। এগুলো ছাড়া তাঁর আরও দায়িত্ব আছে।

রাসূল শুধু ওহীর-ই অনুসরণ করেন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এসব দায়িত্ব পালানার্থে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন তার কোনোটি নিজের ইচ্ছেমতো করেননি বা বলেননি; বরং সবই আল্লাহর নির্দেশে। সূরা নাজমে আছে-

وَ مَا یَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰی  اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْیٌ یُّوْحٰی.

তিনি মনগড়া কথা বলেন না। সেটা তো খালেস ওহী, যা তাঁর কাছে পাঠানো হয়। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩-৪

সূরা আহকাফে আছে-

قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِّنَ الرُّسُلِ وَ مَاۤ اَدْرِیْ مَا یُفْعَلُ بِیْ وَ لَا بِكُمْ  اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوْحٰۤی اِلَیَّ وَ مَاۤ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ مُّبِیْنٌ.

(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি রাসূলগণের মধ্যে অভিনব নই। আমি জানি না, আমার সঙ্গে কী আচরণ করা হবে এবং এটাও (জানি) না যে, তোমাদের সঙ্গে কী আচরণ করা হবে। আমি তো কেবল আমার প্রতি যে অহী নাযিল করা হয়, তারই অনুসরণ করি। আমি তো কেবল একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ৯

এই আয়াতদ্বয় থেকে স্পষ্ট, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনে কারীমের তাফসীর ও ব্যাখ্যা হিসাবে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন, সবই ওহীর ভিত্তিতে। তথাপি বিষয়টি কুরআনে আরো বিশেষভাবেও উল্লেখিত হয়েছে। সূরা কিয়ামায় আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَا تُحَرِّكْ بِهٖ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهٖ،  اِنَّ عَلَیْنَا جَمْعَهٗ وَ قُرْاٰنَهٗ،  فَاِذَا قَرَاْنٰهُ فَاتَّبِعْ قُرْاٰنَهٗ،  ثُمَّ اِنَّ عَلَیْنَا بَیَانَهٗ.

(হে রাসূল!) আপনি এটি (অর্থাৎ কুরআন) তাড়াতাড়ি মুখস্থ করবার জন্য তার সঙ্গে জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। নিশ্চয় এটি (অন্তরে) সংরক্ষণ ও (মুখে) পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই। সুতরাং আমি যখন তা (জিবরীলের মাধ্যমে) পাঠ করি, আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন। এরপর তার বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই। -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ১৬-১৯

সূরা নিসায় বলেন-

اِنَّاۤ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَیْنَ النَّاسِ بِمَاۤ اَرٰىكَ اللهُ وَ لَا تَكُنْ لِّلْخَآىِٕنِیْنَ خَصِیْمًا.

(হে নবী!) নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য-সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আল্লাহ আপনাকে যে উপলব্ধি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে মীমাংসা করতে পারেন। আর আপনি বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হবেন না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৫

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এইসকল কথা ও কাজকে বলে হাদীস ও সুন্নাহ। সুতরাং রাসূলের প্রতি ঈমান আনার অর্থই হল তাঁর সুন্নাহ ও হাদীসের অনুসরণ করা, তাঁর সকল কথা ও কাজ বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া এবং তাঁর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قُلْ اَطِیْعُوا اللهَ وَ الرَّسُوْلَ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَاِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ الْكٰفِرِیْنَ.

(হে নবী!) আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ কাফেরদের পছন্দ করেন না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩২

অন্যত্র বলেন-

وَ مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَّ لَا مُؤْمِنَةٍ اِذَا قَضَی اللهُ وَ رَسُوْلُهٗۤ اَمْرًا اَنْ یَّكُوْنَ لَهُمُ الْخِیَرَةُ مِنْ اَمْرِهِمْ  وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیْنًا.

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা দান করেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর নিজেদের বিষয়ে কোনো এখতিয়ার বাকি থাকে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করলে সে তো সুস্পষ্ট গোমারাহীতে পতিত হল। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৩৬

আরো বলেন-

فَلَا وَ رَبِّكَ لَا یُؤْمِنُوْنَ حَتّٰی یُحَكِّمُوْكَ فِیْمَا شَجَرَ بَیْنَهُمْ ثُمَّ لَا یَجِدُوْا فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیْتَ وَ یُسَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.

না, (হে নবী!) আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে আপনাকে বিচারক মানবে। তারপর আপনি যে রায় দেন, সে বিষয়ে নিজেদের অন্তরে কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করবে না এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করবে। -সূরা নিসা (৪) : ৬৫

সাহাবা-তাবেয়ীনসহ সকল যুগের হকপন্থীগণ এভাবেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করেছেন। তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজ বিনা দ্বিধায় মান্য করেছেন। তাঁর সুন্নাহকে শরয়ী বিধি-বিধানের উৎস এবং কুরআন অনুধাবনের ভিত্তি ও মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

আহলে কুরআনের ফেতনা

কিন্তু দুনিয়াতে ফেতনার অভাব নেই। মানুষের ঈমান-আমল নষ্ট করার জন্য কত ধরনের কত কথা! আহলে কুরআনরা বলে, ‘আমরা শুধু কুরআন মানি। আমাদের কিছু বলতে হলে সরাসরি কুরআন থেকে দেখাতে হবে। কুরআনের বাইরে বা কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা করে কিছু বললে আমরা তা মানি না।’ অর্থাৎ কুরআনের ব্যাখ্যায় রাসূলের হাদীস বা সাহাবায়ে কেরামের বাণী পেশ করলে তারা তা মানতে রাজি নয়। তার মানে, যাঁর উপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং তাঁর থেকে যাঁরা কুরআন শিখেছেন তাঁরা কী বুঝেছেন সেটা নয়; আমরা বা আমি যেটা বুঝেছি সেটাই আসল বুঝ- নাউযুবিল্লাহ! বলুন, এটা কি কুরআন মানা? কখনো নয়।

লক্ষ করুন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কুরআন তিলাওয়াত করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিখিয়েছেন। আমাদেরকে ঠিক সেভাবেই তিলাওয়াত করতে হবে। আমরা যদি নিজেদের ইচ্ছেমতো তিলাওয়াত করি, শব্দ পরিবর্তন করি, হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটাই বা বিন্যাস পরিবর্তন করে ফেলি তাহলে কি বৈধ হবে? কখনো নয়। বরং তা হবে কুরআনের চরম বিকৃতি ও অবমাননা।

একইভাবে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। কোন্ আয়াতের কী মর্ম, কোন্ আয়াতে কী বিধান এবং সেই বিধান পালনের কী নিয়ম- সবকিছু তিনি সাহাবায়ে কেরামকে শিখিয়েছেন। এটা তাঁর দায়িত্ব। তিনি সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন। আমাদের কর্তব্য, রাসূলের শিক্ষাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করা এবং তার আলোকে কুরআন বোঝার চেষ্টা করা। কিন্তু কেউ যদি নিজের মতো করে কুরআন বুঝতে যায় এবং রাসূলের শিক্ষার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তাহলে তার কুরআনও মানা হবে না, রাসূলও মানা হবে না। আর রাসূল ও কুরআন না মানা হলে তার ঈমানের কী হবে? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সবধরনের বক্রতা থেকে হেফাযত করুন- আমীন।

কথার সৌন্দর্যে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না; আসল উদ্দেশ্য বুঝতে হবে

শয়তান বিভিন্নভাবে মানুষকে ওয়াসওয়াসা ও কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। এই কুমন্ত্রণার ভাষাও হয় সুন্দর ও আকর্ষণীয়। যেমন একটা ফেরকার নাম আহলে হাদীস। মানে হাদীসের অনুসারী। প্রশ্ন হল, হাদীসের অনুসারী কে নয়? সকল মুসলমানই তো হাদীসের অনুসারী। এ হিসেবে সব মুসলমান আহলে হাদীস। তাহলে এরা কেন নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ নাম দিয়ে অন্য মুসলমানদের থেকে পৃথক করে রাখে? আসলে এই নামের পিছনে আরেকটা অংশ আছে- ইসলামী ফিকহ অস্বীকারকারী। ফুকাহায়ে কেরাম কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধানগুলোকে যে বিন্যস্ত রূপ দিয়েছেন সেটাকে বলা হয়, আলফিকহুল ইসলামী বা ইসলামী ফিকহ। তারা সে ফিকহ মানে না। অথচ নাম বলার সময় বলে ‘আহলে হাদীস’;  ‘ফিকহ অস্বীকারকারী’ বলে না। কারণ পুরোটা বললে তো মানুষ ধরে ফেলবে, তাদের সমস্যাটা কী?১

আহলে কুরআন নামটাও এই ধরনের। আহলে কুরআন মানে কুরআনের অনুসারী ও কুরআনওয়ালা। এ হিসেবে সব মুসলমানই তো আহলে কুরআন। রাসূলের উপর কুরআন নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কুরআনের অর্থ-মর্ম শিখিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন সাহাবায়ে কেরামকে। সাহাবায়ে কেরাম শিখিয়েছেন তাবেয়ীনকে। এভাবে যুগ যুগ ধরে কুরআন শেখা-শেখানোর ধারা চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। অতএব যুগে যুগে আহলে কুরআন বা কুরআনের অনুসারী বিদ্যমান ছিল এবং থাকবে। তাহলে হঠাৎ এরা নিজেদের আহলে কুরআন বলে অন্যদের থেকে পৃথক করছে কেন? আসলে এ নামের পেছনে আরেকটা অংশ আছে। সেটা হলো হাদীস ও সুন্নাহ অস্বীকারকারী আর এটাই তাদের আসল পরিচয়। কুরআন শেখাতে গিয়ে এবং কুরআনের বিধি-বিধান শেখাতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু বলেছেন ও করেছেন, সেটাই তো সুন্নাহ, সেটাই হাদীস এবং সেটাই হিকমাহ। কিন্তু তারা এই হাদীস-সুন্নাহ মানে না। নিজেদের নাম দিয়েছে ‘আহলে কুরআন’, আসলে এরা হাদীস অস্বীকারকারী। এরা রাসূলের অবমাননা করে এবং কুরআনকে নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুগামী করে।

দেখুন, বাতিলপন্থীদের ওয়াসওয়াসার ভাষা অনেক সময় সুন্দর হয়। তাই কথার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। বরং তার দাওয়াতের পেছনে মূল উদ্দেশ্যেটা কী- তা বুঝতে হবে। আহলে কুরআনের কথাই ধরুন। দাওয়াতের সময় তারা কত সুন্দর কথা বলে; কুরআনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করে। তবে সেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য, মানুষকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহ থেকে বিমুখ করা। মুখে বলে কুরআনের কথা আর অন্তরে থাকে মানুষকে হাদীস থেকে বিমুখ করা।

নবআবিষ্কৃত বিষয়ে সতর্কতা জরুরি

এখানে আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে। যখনই আপনি দ্বীনী বিষয়ে এমন কথা শুনবেন, যা আপনার চারপাশের কেউ-ই বলে না, একদম নবআবিষ্কৃত বিষয়, তখন বুঝতে হবে, এটা বিভ্রান্তি এবং হেদায়েতের নামে গোমরাহি। হাঁ, এমন হতে পারে, একটা বিষয় ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা কিছু মানুষ জানতাম না। এক ভাই এসে আমাদের সংশোধন করে দিলেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিষয়টা আরো অনেকে বলেছেন এবং সেটাই সঠিক। এমনটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু বিষয়টা যদি কেউ-ই না জানে এবং ইসলামের সাড়ে চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে এরূপ কথা কেউ না বলে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই এটা ভ্রষ্টতা ও গোমরাহি। কারণ এরূপ হতেই পারে না- কোনো দ্বীনী আকীদা-বিশ্বাস বা শরীয়তের কোনো মৌলিক বিধানের বিষয়ে মুমিনরা হাজার বছর যাবৎ বিভ্রান্তিতে থাকবে, অতঃপর একজনের আবির্ভাব ঘটবে, আর সে প্রকৃত সত্যটা উদ্ঘাটন করবে।

কুরআন হেফাযতের মর্ম

কুরআন আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন। তার হেফাযতের দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন। হেফাযত বলতে শুধু শব্দের হেফাযত নয়; শব্দ ও মর্ম উভয়েরই হেফাযত। তাই সাড়ে চৌদ্দশ বছর পরও কুরআন সংরক্ষিত ও অবিকৃত। অতএব কেউ যদি বলে বা তার দাবির ফল যদি এই হয় যে, কুরআন বোঝার ও তদনুযায়ী আমল করার লোক চৌদ্দশ বছর যাবৎ ছিল না; এখন হঠাৎ আবিষ্কার হয়েছে কুরআন বোঝার ও কুরআন অনুযায়ী আমল করার লোক- বলুন, এটা কি বোধগম্য? আসলে আমরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগাই না। বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগালে, আল্লাহর রহমতে আমরা অনেক ফেতনা থেকে বেঁচে যেতাম।

কুরআনের প্রকৃত অনুসারী

দেখুন, সাহাবায়ে কেরাম কুরআন শিখেছেন সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। তাঁদের থেকে শিখেছেন তাবেয়ীনে কেরাম। অথচ আহলে কুরআনের কথা অনুযায়ী সাহাবা-তাবেয়ীনের কেউ-ই কুরআনের প্রকৃত অনুসারী ছিলেন না এবং তাঁদের একজনও কুরআনের মর্ম যথাযথ অনুধাবনে সক্ষম হননি। কেননা, তাঁদের কেউই কুরআন অনুসরণের নামে হাদীস অস্বীকার করেননি এবং রাসূলের সুন্নাহ থেকে বিমুখ হননি। বরং রাসূলের হাদীস ও সুন্নাহকেই তাঁরা কুরআন অনুধাবন ও অনুসরণের ভিত্তি ও মাপকাঠি বানিয়েছেন। দেখুন, তাদের মতাদর্শ তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! তাদের মতাদর্শ তো ইসলামের প্রথম সারির অনুসারীদেরকেই কুরআনের মর্ম অনুধাবন ও তার যথাযথ অনুসরণে ব্যর্থ সাব্যস্ত করছে। অথচ তাঁদের সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য হল-

وَ السّٰبِقُوْنَ الْاَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِیْنَ وَ الْاَنْصَارِ وَ الَّذِیْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِاِحْسَانٍ  رَّضِیَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ وَ اَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ تَحْتَهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًا ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِیْم.

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আল্লাহ তাদের জন্য এমন উদ্যানরাজি তৈরি করে রেখেছেন, যার তলদেশে নহর বহমান। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। এটাই মহা সাফল্য। -সূরা তাওবা (৯) : ১০০

আসলে বাতিল মতাদর্শের লোকেরা ভেবেই দেখে না, তাদের ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনা তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে; অন্ধকারের কোন্ অতল গহ্বরে তাদের ঠেলে দিচ্ছে।

সালাত : আহলে কুরআনের গোমরাহির অনেক বড় প্রকাশক্ষেত্র

আগেই বলা হয়েছে, রাসূলের শেখানো তিলাওয়াত যেমন ধারাবাহিকভাবে আমাদের নিকট রয়েছে তেমনি তাঁর শিক্ষাও আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ -এর তিলাওয়াত যেভাবে আমরা রাসূলুল্লাহ থেকে শিখেছি, সেটার বিধানও আমরা তাঁর থেকে লাভ করেছি। সালাত কায়েম কীভাবে করতে হবে, কখন করতে হবে এবং ফরয সালাত মোট কত ওয়াক্ত ও কত রাকাত সেটা আমরা রাসূলুল্লাহ থেকে জেনেছি। এই শিক্ষাটুকু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে না পেলে আমাদের পক্ষে কুরআন অনুসরণ সম্ভব হতো না।

আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও গোমরাহির অনেক বড় একটা প্রকাশক্ষেত্র হল সালাত। তাই এ বিষয়ে কিছু বলার ইচ্ছা করছি। সূরা বনী ইসরাঈলের এই আয়াতটি দেখুন-

اَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ اِلٰی غَسَقِ الَّیْلِ وَ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ اِنَّ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا.

(হে নবী!) সূর্য হেলার সময় সালাত কায়েম করুন রাত অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত এবং কায়েম করুন ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাতে ঘটে থাকে সমাবেশ। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৭৮

এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়-

এক. আল্লাহ তাআলা সালাত কায়েমের আদেশ করেছেন। তবে সালাত কায়েম কীভাবে করবে- তার বর্ণনা দেননি এবং কুরআন মাজীদের কোথাও দেননি। অথচ সূরা বাকারায় বলেন-

حٰفِظُوْا عَلَی الصَّلَوٰتِ وَ الصَّلٰوةِ الْوُسْطٰی  وَ قُوْمُوْا لِلهِ قٰنِتِیْنَ، فَاِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا اَوْ رُكْبَانًا  فَاِذَاۤ اَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَّا لَمْ تَكُوْنُوْا تَعْلَمُوْنَ.

তোমরা পুরোপুরি যত্নবান থেকো সালাতসমূহের প্রতি এবং (বিশেষভাবে) মধ্যবর্তী সালাতের প্রতি২। তোমরা আল্লাহর সামনে আদবের সঙ্গে অনুগত হয়ে দাঁড়িয়ো। তোমরা যদি (শত্রুর) ভয় কর, তবে দাঁড়িয়ে বা আরোহী অবস্থায় (সালাত আদায় করে নিয়ো)। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ অবস্থা লাভ কর তখন আল্লাহর যিকির সেইভাবে করবে, যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যে সম্পর্কে তোমরা অনবগত ছিলে। -সূরা বাকারা (২) : ২৩৮-২৩৯

এখানে-

فَاِذَاۤ اَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَّا لَمْ تَكُوْنُوْا تَعْلَمُوْنَ .

(অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ অবস্থা লাভ কর তখন আল্লাহর যিকির সেইভাবে করবে, যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যে সম্পর্কে তোমরা অনবগত ছিলে।)-অংশটি খেয়াল করুন। আগ-পর থেকে স্পষ্ট, এখানে যিকির বলতে যেকোনো যিকির উদ্দেশ্য নয়; বরং সালাত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ভীতিকর পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে তোমরা দাঁড়িয়ে বা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে। এরপর পরিস্থিতি নিরাপদ হয়ে এলে তোমরা সেই নিয়মে সালাত আদায় করবে, যে নিয়ম তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, সে নিয়ম তো কুরআনে নেই; আমরা  কোত্থেকে শিখলাম? আল্লাহ আমাদের কীভাবে শেখালেন? উত্তর স্পষ্ট, আমরা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শিখেছি। তিনি তাঁর সুন্নাহ ও হাদীসের মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। রাসূলের এ শেখানোকেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন- ‘আল্লাহর শেখানো’। ইরশাদ হয়েছে- كَمَا عَلَّمَكُمْ  অর্থাৎ যেভাবে আল্লাহ তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেখানো সালাতের পদ্ধতি থেকে বিমুখ হওয়া মানে আল্লাহর শেখানো পদ্ধতি থেকে বিমুখ হওয়া।

রাসূলের শিক্ষাদানের পদ্ধতি

রাসূলুল্লাহর কাছে সালাতের পদ্ধতি সর্বপ্রথম শিখেছেন সাহাবায়ে কেরাম। তিনি তাঁদের মৌখিকভাবেও শিখিয়েছেন আবার নিয়মিত তাঁদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করে তার বাস্তব রূপও দেখিয়েছেন। আর বলেছেন-

صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي.

তোমরা সেইভাবে সালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে আদায় করতে দেখ। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০০৮

এরপর সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবেয়ীন, তাঁদের থেকে তাবে তাবেয়ীন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরী তাদের পূর্বসূরীদের থেকে শিখেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে।

শেখা-শেখানোর এই পন্থা কেবল সালাতেই নয়; অন্যান্য আমলেও ৩। যেমন হজ্বের বিষয়ে আল্লাহর হুকুম-

وَ لِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا.

মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের উপর ফরয আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্ব করা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭

কিন্তু হজ্বের সম্পূর্ণ বিধান কুরআন মাজীদে নেই। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি যেন মানুষকে হজ্বের পূর্ণাঙ্গ বিধান শিক্ষা দেন। বিদায় হজ্বে তিনি বলেন-

لِتَأْخُذُوا مَنَاسِكَكُمْ، فَإِنِّي لَا أَدْرِي لَعَلِّي لَا أَحُجّ بَعْدَ حَجّتِي هَذِهِ.

তোমরা (আমার কাছ থেকে) হজ্বের নিয়ম-কানুন শিখে নাও। কারণ আমি জানি না, এই হজ্বের পর আমি আর হজ্ব করতে পারব কি না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২৭৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯৭০

দুই. এ আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা মধ্যাহ্নের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলার সময় থেকে রাত অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় কর। আয়াতের শাব্দিক অর্থ তো এমনই। এখন কেউ যদি রাসূলুল্লাহর ব্যাখ্যা ও সুন্নাহ ছেড়ে শুধু শাব্দিক তরজমা নিয়ে বসে থাকে,৪  তাকে তো সূর্য হেলার সময় থেকে রাত অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত সালাতেই থাকতে হবে!

এবার সূরা হুদের এই আয়াতটি দেখুন-

وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ  ذٰلِكَ ذِكْرٰی لِلذّٰكِرِیْنَ

(হে নবী!) আপনি দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে সালাত কায়েম করুন। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ।’ -সূরা হূদ (১১) : ১১৪

প্রশ্ন হল, কোন্ সালাতের নির্দিষ্ট সময় কতটুকু, যার আগে সালাত আদায় করলে তা ধর্তব্য হবে না আর তার পরে আদায় করলে যথাসময়ে সালাত আদায়কারী বিবেচিত হবে না? আমরা লক্ষ্য করেছি, বিষয়টা এই দুই আয়াতে নেই এবং কুরআন মাজীদের কোনো আয়াতে নেই। অথচ সূরা নিসায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

اِنَّ الصَّلٰوةَ كَانَتْ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ كِتٰبًا مَّوْقُوْتًا.

নিঃসন্দেহে সালাত মুমিনদের উপর সময়াবদ্ধ ফরয। -সূরা নিসা (৪) : ১০৩

এই সময়াবদ্ধতার পরিপূর্ণ বিবরণ কুরআনে মাজীদে নেই; আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্য়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা। তাঁর শেখানো ওয়াক্ত মোতাবেক সালাত আদায় করার বিষয়েই কুরআন বলছে-

اِنَّ الصَّلٰوةَ كَانَتْ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ كِتٰبًا مَّوْقُوْتًا.

(নিঃসন্দেহে সালাত মুমিনদের উপর সময়াবদ্ধ ফরয।)

তাই রাসূলের শেখানো পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা অমান্য করা মানে- কুরআনের এই ফরয বিধানের অবজ্ঞা করা।

হাদীস ও সুন্নাহ্য় পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা

হাদীসে আছে, বুরায়দা রা. থেকে বর্ণিত-

عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّ رَجُلًا سَأَلَهُ عَنْ وَقْتِ الصَّلَاةِ، فَقَالَ لَهُ: صَلِّ مَعَنَا هَذَيْنِ - يَعْنِي الْيَوْمَيْنِ - فَلَمَّا زَالَتِ الشَّمْسُ أَمَرَ بِلَالًا فَأَذَّنَ، ثُمَّ أَمَرَهُ، فَأَقَامَ الظُّهْرَ، ثُمَّ أَمَرَهُ، فَأَقَامَ الْعَصْرَ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ بَيْضَاءُ نَقِيَّةٌ، ثُمَّ أَمَرَهُ فَأَقَامَ الْمَغْرِبَ حِينَ غَابَتِ الشَّمْسُ، ثُمَّ أَمَرَهُ فَأَقَامَ الْعِشَاءَ حِينَ غَابَ الشَّفَقُ، ثُمَّ أَمَرَهُ فَأَقَامَ الْفَجْرَ حِينَ طَلَعَ الْفَجْرُ، فَلَمَّا أَنْ كَانَ الْيَوْمُ الثَّانِي أَمَرَهُ فَأَبْرَدَ بِالظُّهْرِ، فَأَبْرَدَ بِهَا، فَأَنْعَمَ أَنْ يُبْرِدَ بِهَا، وَصَلَّى الْعَصْرَ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ أَخَّرَهَا فَوْقَ الَّذِي كَانَ، وَصَلَّى الْمَغْرِبَ قَبْلَ أَنْ يَغِيبَ الشَّفَقُ، وَصَلَّى الْعِشَاءَ بَعْدَمَا ذَهَبَ ثُلُثُ اللَّيْلِ، وَصَلَّى الْفَجْرَ فَأَسْفَرَ بِهَا، ثُمَّ قَالَ: أَيْنَ السَّائِلُ عَنْ وَقْتِ الصَّلَاةِ؟ فَقَالَ الرَّجُلُ: أَنَا، يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: وَقْتُ صَلَاتِكُمْ بَيْنَ مَا رَأَيْتُمْ.

এক ব্যক্তি সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি এ দুদিন আমাদের সঙ্গে সালাত পড়’।

প্রথম দিন (মধ্যাহ্নের) সূর্য (কিছুটা পশ্চিমে) হেলে যাওয়ার পর বেলাল রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে যোহরের আযান দিলেন অতঃপর ইকামত দিলেন। এরপর সূর্য উপরে সাদা থাকাবস্থায়ই বিলাল রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে আসরের আযান দিলেন এবং ইকামত দিলেন। এরপর সূর্যাস্তের পর মাগরিব এবং শাফাক (পশ্চিমাকাশের আলোক-আভা) অস্তমিত হওয়ার পর এশার সালাত আদায় করলেন।

দ্বিতীয় দিন বেলাল রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে যোহরের আযানে বিলম্ব করলেন। রোদের তাপ অনেক ঠাণ্ডা হওয়ার পর যোহরের সালাত আদায় করা হল। এরপর আসরের সালাতও বিলম্বিত করা হল এবং সূর্য কিছুটা উচ্চতায় থাকাবস্থায় সালাত আদায় করা হল। এরপর মাগরিব শাফাক (পশ্চিমাকাশের আলোক-আভা) অস্তমিত হওয়ার (কিছু) আগে আদায় করা হল এবং এশা রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্বিত করা হল। ফজরের সালাত চারদিকে ভালোভাবে ফর্সা হওয়ার পর আদায় করা হল। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই প্রশ্নকারীকে ডাকলেন। সাহাবী উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই দুই সময়ের মধ্যেই তোমাদের সালাতের সময় নির্ধারিত।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬১৩

এছাড়াও আরো অনেক হাদীস ও আসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সালাতের ওয়াক্ত সংক্রান্ত নির্দেশনা বর্ণিত রয়েছে।

বিখ্যাত মুফাসসির হাফিযুল হাদীস ইবনে কাসীর রাহ. (৭৭৪ হি.) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৮ সংখ্যক আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-

وَقَدْ ثَبَتَتِ السُّنَّةُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَاتُرًا مِنْ أَفْعَالِهِ وَأَقْوَالِهِ بِتَفَاصِيلَ هَذِهِ الْأَوْقَاتِ، عَلَى مَا عَلَيْهِ عَمَلُ أَهْلِ الْإِسْلَامِ الْيَوْمَ، مِمَّا تَلَقَّوْهُ خَلَفًا عَنْ سَلَفٍ، وَقَرْنًا بَعْدَ قَرْنٍ.

অর্থাৎ (সালাতের) এই ওয়াক্তগুলোর বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নিয়মটি নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের (ফরয স্তরের) সুন্নাহ। এই সুন্নাহ তাঁর বহু কওলী ও ফে‘লী হাদীস দ্বারা তাওয়াতুরের সঙ্গে প্রমাণিত। যুগ যুগ ধরে তা মুসলিম উম্মাহ্র সম্মিলিত কর্মধারা। প্রত্যেক যুগের উত্তরসূরীরা তাদের পূর্বসূরীদের থেকে তা গ্রহণ করেছে। এভাবে আমলের ধারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৩, পৃ. ৮৯

কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ

সুতরাং পূর্বোল্লিখিত সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৮ সংখ্যক আয়াত এবং সূরা হূদের ১১৪ সংখ্যক আয়াতের কী অর্থ- সেটা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর মাধ্যমে বুঝতে পারলাম। অর্থাৎ সূর্য হেলার সময় থেকে রাত অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত এই পুরোটা সময় সালাতে থাকতে হবে না। বরং এটাকে চার ভাগ করা হয়েছে; অর্থাৎ চার ওয়াক্ত- যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা। প্রত্যেক ওয়াক্তের শুরু-শেষ নির্ধারিত। পঞ্চম ওয়াক্ত ফজর। সেটা এই আয়াতে قُرْاٰنَ الْفَجْرِ  শব্দে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বমোট পাঁচ ওয়াক্ত। আর সূরা হূদের আয়াতে, দিনের দুই প্রান্তের প্রথম প্রান্ত দ্বারা উদ্দেশ্য ফজর আর দ্বিতীয় প্রান্ত দ্বারা উদ্দেশ্য যোহর ও আসর। রাতের কিছু অংশ দ্বারা উদ্দেশ্য মাগরিব ও এশা- এই মোট পাঁচ ওয়াক্ত। অতএব এই দুই আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের আদেশ করা হয়েছে।

পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা কুরআন মাজীদের আরো আয়াতে আছে। যেমন সূরা রূমে আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَسُبْحٰنَ اللهِ حِیْنَ تُمْسُوْنَ وَ حِیْنَ تُصْبِحُوْنَ،  وَ لَهُ الْحَمْدُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ عَشِیًّا وَّ حِیْنَ تُظْهِرُوْنَ.

আয়াতের তরজমা এই-

তোমরা আল্লাহর তাসবীহতে রত থাক যখন তোমরা সন্ধ্যায় উপনীত হও এবং যখন তোমরা ভোরের সম্মুখীন হও। এবং তাঁরই প্রশংসা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে। বিকেল বেলায়  (তাঁর তাসবীহতে রত হও) এবং যোহরের সময়। -সূরা রূম (৩০) : ১৭-১৮

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাত ভাই এবং তাঁর বিশিষ্ট সাহাবী। তাঁর জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করেছেন-

اللهُمّ عَلِّمْهُ الْكِتَابَ.

হে আল্লাহ, আপনি তাকে কুরআন শিখিয়ে দিন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৩৭৯

রাসূলের এই দুআ আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন। তাই তাঁর উপাধি ‘রঈসুল মুফাসসিরীন’-মুফাসসিরগণের সরদার। তিনি এই আয়াতে তাসবীহের ব্যাখ্যা করেছেন সালাত। এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা কোন্ আয়াতে আছে? তিনি উত্তরে এই দুই আয়াত এবং সূরা নূরের ৫৮ সংখ্যক আয়াতের কিছু অংশ তিলাওয়াত করলেন, যাতে এশার সালাতের কথা আছে। আসারটি মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক (১৭৭২), আলমুজামুল কাবীর তবারানী (১০/২৪৭-২৪৮), তাফসীরে তবারী (১৮/৪৭৪), মুসতাদরাকে হাকেম (৩৫৮৩) ও সুনানে কুবরা বায়হাকী (৩/৩৫৯)সহ অনেক কিতাবে আছে। আমরা এখানে আসারটি মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক থেকে সনদসহ উল্লেখ করছি-

عَنِ الثَّوْرِيِّ، عَنْ عَاصِمٍ، عَنْ أَبِي رَزِينٍ قَالَ: خَاصَمَ نَافِعُ بْنُ الْأَزْرَقِ ابْنَ الْعَبَّاسِ، فَقَالَ: هَلْ تَجِد الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ فِي الْقُرْآنِ؟ فَقَالَ: نَعَمْ، ثُمَّ قَرَأَ عَلَيْهِ: فَسُبْحٰنَ اللهِ حِیْنَ تُمْسُوْنَ وَ حِیْنَ تُصْبِحُوْن: الْمَغْرِبُ وَالْفَجْرُ، وَ عَشِیًّا: الْعَصْرُ، وَّ حِیْنَ تُظْهِرُوْنَ : الظُّهْرُ، قَالَ: وَ مِنْۢ بَعْدِ صَلٰوةِ الْعِشَآء.

অর্থাৎ নাফে‘ ইবনে আযরাক নামক এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা পেয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁ। এরপর তিলাওয়াত করলেন, فَسُبْحٰنَ اللهِ  حِیْنَ تُمْسُوْنَ وَ حِیْنَ تُصْبِحُوْنَ (অর্থাৎ) মাগরিব ও ফজর, ‘ وَ عَشِیًّا’ : আসর, ‘وَّ حِیْنَ تُظْهِرُوْنَ’ : যোহর। এরপর তিলাওয়াত করলেন, وَ مِنْۢ بَعْدِ صَلٰوةِ الْعِشَآء (অর্থাৎ এশা)। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, খ. ১, পৃ. ৪৫৪, হাদীস ১৭৭২

قال الحاكم في المستدرك: هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه.

অতএব এখানে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিবরণ পেলাম। حِیْنَ تُمْسُوْنَ -এ মাগরিব ও এশা, وَ حِیْنَ تُصْبِحُوْنَ -এ ফজর, وَ عَشِیًّا -এ আসর এবং وَ حِیْنَ تُظْهِرُوْنَ -এ যোহর- এই মোট পাঁচ ওয়াক্ত।

সূরা রূমের আয়াতের অনুরূপ আয়াত আছে সূরা ত্ব-হায়। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন-

فَاصْبِرْ عَلٰی مَا یَقُوْلُوْنَ وَ سَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَ قَبْلَ غُرُوْبِهَا  وَ مِنْ اٰنَآئِ الَّیْلِ فَسَبِّحْ وَ اَطْرَافَ النَّهَارِ لَعَلَّكَ تَرْضٰی.

সুতরাং (হে নবী!) তারা যেসব কথা বলে, তাতে সবর করুন। আর সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে নিজ প্রতিপালকের তাসবীহ ও হামদে রত থাকুন। রাতের মুহূর্তগুলোতেও তাসবীহতে রত থাকুন এবং দিনের প্রান্তসমূহেও, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যান। -সূরা ত্ব-হা (২০) : ১৩০

এখানে তাসবীহ ও হামদের কী অর্থ? জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذْ نَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ، فَقَالَ: أَمَا إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ، لَا تُضَامَّونَ فِي رُؤْيَتِهِ، فَإِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لَا تُغْلَبُوا عَلَى صَلَاةٍ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ، وَقَبْلَ غُرُوبِهَا - يَعْنِي الْعَصْرَ وَالْفَجْرَ -، ثُمَّ قَرَأَ جَرِيرٌ وَ سَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَ قَبْلَ غُرُوْبِهَا.

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, শোন! অচিরেই তোমাদের রবকে তোমরা দেখতে পাবে, যেমন এ চাঁদকে তোমরা দেখতে পাচ্ছ। তাঁকে দেখতে গিয়ে তোমরা পরস্পর ভিড়ের চাপে পড়বে না। যদি তোমরা সক্ষম হও তবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের আগে সালাত আদায়ে পিছপা হয়ো না। অর্থাৎ আসর ও ফজর। এরপর জারীর রা. তিলাওয়াত করলেন-

وَ سَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَ قَبْلَ غُرُوْبِهَا

(আর সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে নিজ প্রতিপালকের তাসবীহ ও হামদে রত থাকুন।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৩৩; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৪

এখানে এটা স্পষ্ট, বিখ্যাত সাহাবী জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. তাসবীহ ও হামদ শব্দ থেকে সালাত অর্থই বুঝেছেন। তাছাড়া আরবী ভাষায় এ ধরনের ব্যবহার অপরিচিত কিছু নয়। একটি সমগ্রের অংশবিশেষ উল্লেখ করে পুরো সমগ্রটিকে বোঝানো- এটি আরবী ভাষায় অতি পরিচিত একটি রীতি। কুরআন মাজীদেই এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে, এমনকি সালাতের ক্ষেত্রেই। যেমন ইতিপূর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৩৯ সংখ্যক আয়াতে দেখেছি; সেখানে যিকির শব্দটি সালাতের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আরো কিছু আয়াত দেখুন-

وَ الَّذِیْنَ یَبِیْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا.

এবং যারা রাত অতিবাহিত করে নিজ প্রতিপালকের সামনে (কখনও) সিজদারত অবস্থায় এবং (কখনও) দণ্ডায়মান অবস্থায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৪

اَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ الَّیْلِ سَاجِدًا وَّ قَآىِٕمًا...

যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে, (কখনও) সিজদাবস্থায় এবং (কখনও) দাঁড়িয়ে...। -সূরা যুমার (৩৯) : ০৯

وَ اِذْ بَوَّاْنَا لِاِبْرٰهِیْمَ مَكَانَ الْبَیْتِ اَنْ لَّا تُشْرِكْ بِیْ شَیْـًٔا وَّ طَهِّرْ بَیْتِیَ لِلطَّآىِٕفِیْنَ وَ الْقَآىِٕمِیْنَ وَ الرُّكَّعِ السُّجُوْدِ.

এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সেই ঘর (অর্থাৎ কাবাগৃহ)-এর স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং তাঁকে হুকুম দিয়েছিলাম,) আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করবেন না এবং আমার ঘরকে সেইসকল লোকের জন্য পবিত্র রাখুন, যারা (এখানে) তওয়াফ করে, দাঁড়ায় ও রুকূ-সিজদা করে। -সূরা হজ্ব (২২) :  ২৬

এই আয়াতসমূহে দাঁড়ানো ও রুকূ-সিজদার কথা আছে। কিন্তু স্পষ্ট, এখানে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা বা রুকূ-সিজদা করা উদ্দেশ্য নয়; বরং পূর্ণাঙ্গ সালাত আদায় করাই উদ্দেশ্য।

সুতরাং প্রতীয়মান হল, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা কুরআন মাজীদে আছে। একসঙ্গেও আছে, যেমন সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৮ সংখ্যক আয়াতে ও সূরা হূদ-এর ১১৪ সংখ্যক আয়াতে। আবার আলাদাভাবেও দু-এক ওয়াক্তের কথাও আছে, যেমন সূরা নূরের ৭৮ সংখ্যক আয়াতে এশার সালাতের কথা আর সূরা বাকারার ২৩৮ সংখ্যক আয়াতে আসরের সালাতের কথা।

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর সর্ববাদিসম্মত আকীদা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গোটা মুসলিম উম্মাহর সর্ববাদিসম্মত আকীদা হল, ‘দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরয- ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা। ফজরের সালাত দুই রাকাত (ফরয), যোহরের সালাত চার রাকাত (ফরয), আসরের সালাত চার রাকাত (ফরয), মাগরিবের সালাত তিন রাকাত (ফরয) এবং এশার সালাত চার রাকাত (ফরয)। জুমার দিন যোহরের পরিবর্তে জুমার সালাত দুই রাকাত (ফরয) এবং মুসাফিরদের জন্য চার রাকাতের সালাত দুই রাকাত। এ বিষয়ে কারও কোনো ইখতিলাফ নেই। সালাতের শাখাগত কিছু বিষয়ে হয়ত ইখতিলাফ আছে। যেমন, আমীন আস্তে বলা-জোরে বলা, ইমামের পিছনে কিরাত পড়া-না পড়া, রফয়ে ইয়াদাইন করা-না করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে দলীলের আলোকে ইখতিলাফ হয়েছে আর ইখতিলাফের শর্ত ও আদব বজায় রেখে তা প্রকাশের সুযোগও রয়েছে। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং সেগুলোর ওয়াক্ত ও রাকাত সংখ্যা নিয়ে কারো কোনো ইখতিলাফ নেই এবং তার সুযোগও নেই। এসবের কোনো একটিকে অস্বীকার করা বা বিকৃত করা স্পষ্ট কুফুরী।

সালাত বিষয়ে আহলে কুরআনের বিকৃতি

কিন্তু আফসোস, শত আফসোস নব্য ‘আহলে কুরআন’-এর প্রতি। এরা দ্বীনের এই স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ববাদিসম্মত বিষয়েও চরম বিকৃতি ঘটিয়েছে। তাদের এক দলের মতে সালাত তিন ওয়াক্ত; আরেক দলের মতে দুই ওয়াক্ত। আর সকল সালাত দুই রাকাত! নাউযুবিল্লাহ। এই হল তাদের কুরআন অনুসরণ!

তাদের দাবি, কুরআন মাজীদে তারা নাকি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পায়নি। তাদের একদল পেয়েছে তিন ওয়াক্ত, আরেক দল দুই ওয়াক্ত। আর রাকাত পেয়েছে দুই রাকাত। অথচ ইতিপূর্বে আমরা কুরআনে কারীম থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিবরণ দেখিয়েছি। আর রাকাত সংখ্যা নিয়ে তারা যা বলে সেটা তাদের আরেক বিকৃতি। এ সম্পর্কে সামনের কোনো সংখ্যায় আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

আশ্চর্যের বিষয়, তারা নাকি কুরআনে জুমার সালাতের (সালাতুল জুমুআর) বিবরণ পায়নি! অথচ কুরআনে ‘জুমুআ’ নামে স্বতন্ত্র একটি সূরাই আছে এবং সেখানে জুমার সালাতের নির্দেশ আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوةِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللهِ وَ ذَرُوا الْبَیْعَ،  ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ، فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوةُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَ اذْكُرُوا اللهَ كَثِیْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.

হে মুমিনগণ! জুমার দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হয় তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। অতঃপর নামায শেষ হয়ে গেলে তোমরা যমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর। এবং আল্লাহকে স্মরণ কর বেশি বেশি যাতে তোমরা সফলকাম হও। -সূরা জুমুআ (৬২) : ৯-১০

রাসূলের সুন্নাহ এবং মুমিনদের ইজমা ও ঐকমত্যের গুরুত্ব

কথা হল, যদি ধরেও নিই, কুরআন মাজীদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের আলোচনা নেই, তাতে কী হয়েছে? পাঁচ ওয়াক্ত সালাত রাসূলের সুন্নাহ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তিনি নিজে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেছেন এবং উম্মতকে তা শিখিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন দান করেছেন। তাঁর সাক্ষ্যের দ্বারা আমরা বিশ্বাস করেছি- এটি আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব। তিনিই আমাদের জানিয়েছেন (আর তিনি যে জানিয়েছেন সেটা তাঁর থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত), আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন- ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা। ফজরের সালাত দুই রাকাত (ফরয), যোহরের সালাত চার রাকাত (ফরয), আসরের সালাত চার রাকাত (ফরয), মাগরিবের সালাত তিন রাকাত (ফরয) এবং এশার সালাত চার রাকাত (ফরয)। এসব তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন। এবার বলুন, তাঁর এই কথা বিশ্বাস না করার কী কারণ থাকতে পারে?  ‘কুরআনে এর আলোচনা নেই’- এই কারণে কি তাঁর কথা অবিশ্বাস করা যাবে?

দেখুন, اَقِمِ الصَّلٰوةَ  (হে নবী! আপনি সালাত আদায় করুন।) বলে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাতের আদেশ করেছেন। জানা কথা, এতে গোটা মুসলিম উম্মাহ্ই আদিষ্ট। অনেক আয়াতে اَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ (তোমরা সালাত আদায় কর।) বলে রাসূলুল্লাহসহ পুরো মুসলিম উম্মাহকে সালাতের আদেশ করেছেন। তবে সালাত কতবার, কোন্ সময়, কত রাকাত এবং তা কীভাবে আদায় করবে- সেটা আল্লাহ তাআলাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিখিয়েছেন। অতঃপর তিনি সেভাবেই তাঁর উম্মতকে শিখিয়েছেন।

এখন কেউ যদি এমন করে- রাসূলের কথায় সে তো বিশ্বাস করল, اَقِمِ الصَّلٰوةَ ও اَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ  কুরআনের আয়াত; কিন্তু আল্লাহ যে রাসূলকে এই আয়াতদ্বয়ের মর্ম এবং তার বিধান আদায়ের পদ্ধতি শিখিয়েছেন, সেটা সে রাসূলের কথায় বিশ্বাস করতে পারল না। তাহলে বলুন, এটা কেমন ঈমান এবং কুরআনের কেমন অনুসরণ?! আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের এ কেমন রূপ?!

নবউদ্গত ঈমানের পথ থেকে বিচ্যুত এই বিচ্ছিন্ন কিছু লোক ছাড়া আজকের পুরো মুসলিম উম্মাহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিষয়ে একমত। তাদের বিশ্বাস এবং আমল এক ও অভিন্ন। এটি তারা গ্রহণ করেছে তাদের পূর্বসূরীদের থেকে। তারা গ্রহণ করেছে তাদের পূর্বসূরী থেকে। এভাবে তা যুগপরম্পরায় অবিচ্ছিন্ন ধারায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। তার মানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গোটা মুসলিম উম্মাহর নিকট একটি স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ববাদিসম্মত বিষয়। তাহলে বলুন, এরূপ প্রতিষ্ঠিত বিষয় অস্বীকারের কী যুক্তি? শুধু কি এই যে, কুরআনে তার উল্লেখ নেই? আহলে কুরআন নামধারীরা তো এই ছুতো দিয়েই সব অস্বীকার করে দেয়।

দেখুন, কুরআন নিজেই নিজের পরিচয় বলেছে। কুরআন কী, কুরআন কে নাযিল করেছেন, কুরআন কার উপর নাযিল হয়েছে, কুরআনের ব্যাখ্যা কে করবেন, কে কুরআন শেখাবেন, কুরআনের বিধানগুলো কার থেকে গ্রহণ করতে হবে, কুরআন অনুসরণের  নিয়ম কী- এই সবকিছু কুরআনে রয়েছে। কুরআন বলছে, কুরআনের ব্যাখ্যা করবেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তিনি শেখাবেন কুরআন, তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করতে হবে কুরআনের বিধি-বিধান। কুরআন এটাও বলছে, কোনো বিষয়ে মুমিনগণ একমত হলে এবং সকল মুমিন কোনো একটি পথ গ্রহণ করলে তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। এটাই কুরআনের শিক্ষা। দেখুন সূরা নিসার আয়াত-

وَ مَنْ یُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الْهُدٰی وَ یَتَّبِعْ غَیْرَ سَبِیْلِ الْمُؤْمِنِیْنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصْلِهٖ جَهَنَّمَ  وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا۠

আর যে ব্যক্তি তার সামনে হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ অনুসরণ করবে, আমি তাকে সেই পথেই ছেড়ে দেব, যা সে অবলম্বন করেছে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা অতি মন্দ ঠিকানা। -সূরা নিসা (৪) : ১১৫

এ আয়াত পড়ুন আর ‘আহলে কুরআনের’ কর্মকাণ্ড দেখুন। এরা রাসূলুল্লাহর সুন্নাহও মানে না এবং মুমিনদের পথও অনুসরণ করে না।৫ এরা মুমিনদের স্বতঃসিদ্ধ সর্ববাদিসম্মত এবং অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোকে স্বীকার করে না। অথচ তাদের দাবি, তারা ‘আহলে কুরআন’! তাদের অবস্থা দেখে কুরআন মাজীদের এই আয়াত মনে পড়ে-

یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ  وَ نَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهٖ

তারা বাণীসমূহকে তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে দেয় এবং তাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তার একটি বড় অংশ ভুলে যায়। -সূরা মায়েদা (৫) : ১৩

আহলে কুরআনের ফেতনা কোনো সাধারণ ফেতনা নয়; অনেক ভয়াবহ ফেতনা। তারা যে ছুতো ধরে এগুচ্ছে, ধীরে ধীরে তারা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক সুন্নাহ এবং মুসলিম উম্মাহর অনেক স্বতঃসিদ্ধ ও সর্ববাদিসম্মত বিষয়কে অস্বীকার বা বিকৃত করে ফেলবে। একেকবার একেক বিষয় নিয়ে আওয়াজ তুলবে আর বলবে, ‘এটা কুরআনে নেই; আমরা তা মানি না।’

আজ থেকে বিশ-বাইশ বছর আগের কথা। মারকাযুদ দাওয়াহ্য় তাদের দুজন লোক এসেছিল। এসে বলে, ‘এই যে-

أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ.

-এটা আপনারা কোথায় পেয়েছেন? অর্থাৎ ঈমানের কালিমা নিয়েই তাদের সংশয়; নাউযুবিল্লাহ।

এ ফেতনা সম্পর্কে রাসূলের সতর্কবাণী

এ ধরনের লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তিনি উম্মতকে এদের বিষয়ে সতর্ক করে গিয়েছেন। মিকদাম ইবনে মা‘দীকারিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَلاَ هَلْ عَسَى رَجُلٌ يَبْلُغُهُ الحَدِيثُ عَنِّي وَهُوَ مُتَّكِئٌ عَلَى أَرِيكَتِهِ، فَيَقُولُ: بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ كِتَابُ اللهِ، فَمَا وَجَدْنَا فِيهِ حَلاَلاً اسْتَحْلَلْنَاهُ. وَمَا وَجَدْنَا فِيهِ حَرَامًا حَرَّمْنَاهُ، وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللهِ كَمَا حَرَّمَ اللهُ.

শুনে রাখ! হয়ত এমন ব্যক্তির উদ্ভব হবে যে, সে তার সুসজ্জিত আসনে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে; তখন তার কাছে আমার কোনো হাদীস পৌঁছলে সে বলে উঠবে, আমাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে তো আল্লাহর কিতাবই আছে। এতে আমরা যা হালাল হিসেবে পাব তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করব আর যা হারাম হিসেবে পাব তা হারাম মনে করব। অথচ (প্রকৃত অবস্থা হল এই যে,) রাসূলুল্লাহ যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতই হারাম। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬০৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১২

قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ مِنْ هَذَا الوَجْهِ.

দ্বীনী বিষয়ে প্রশ্ন করার নিয়ম

আসলে যারা বলে, ‘কুরআন থেকে সবকিছু দেখাতে হবে; কুরআনের বাইরে কিছু বললে মানা যাবে না’- তাদের এই কথা একদম ভুল। যে কোনো দ্বীনী বিষয়ে প্রশ্ন করার নিয়ম আছে। বলতে হবে, বিষয়টা আমাকে কুরআনে দেখান; নতুবা কুরআন যাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর সুন্নাহ্য় দেখান; না হয় কুরআন-সুন্নাহ যেসব বিষয়কে শরীয়তের বিধি-বিধানের উৎস বা দলীল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেসব বিষয় থেকে দেখান। তাহলেই কথা পুরা হবে। কারণ বিষয়টা হয়ত কুরআনে থাকবে কিংবা রাসূলের সুন্নাহ্য় থাকবে অথবা কুরআন-সুন্নাহ যেসব বিষয়কে শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেসবের কোনোটিতে থাকবে। অতএব ‘সবকিছু কুরআন থেকে দেখাতে হবে’- এটা একেবারে বেমক্কা কথা।

রাসূল সম্পর্কে ‘আহলে কুরআনের’ ধারণা

কিন্তু ‘আহলে কুরআনের’ কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট, এরা কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়তের দলীলাদি সম্পর্কে একদম বেখবর। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা যেরূপ ধ্যান-ধারণা পোষণ করে তা অত্যন্ত অসম্মানজনক। কারণ, তাদের কাথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের দাবি তো এই যে, তাদের ধারণায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ হল ডাকপিয়নের কাজ! ডাকপিয়নের কাজ হল গ্রাহকের হাতে পত্র ধরিয়ে দেয়া। ব্যস, এই তার কাজ। এরপর পত্রে কী আছে, কোন্ কথার কী অর্থ এবং তা বাস্তবায়নের কী পদ্ধতি- এইসব বোঝা গ্রাহকের নিজের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে পিয়ন তাকে কোনো নির্দেশনা দেয় না; পিয়নের কাজ তো শুধু পত্র পৌঁছে দেয়া। আহলে কুরআন নামধারীরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ ও দায়িত্বকে এই স্তরে নামিয়ে এনেছে। নাউযু বিল্লাহ।

রাসূলের দায়িত্ব কী এবং কী তাঁর মর্যাদা- সেটা তো কুরআনেই আছে। আল্লাহ তাআলাই কুরআনে বলে দিয়েছেন, রাসূলের পরিচয় কী, তাঁর দায়িত্ব কী এবং কেন তাঁকে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসাবে পঠিয়েছেন। কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ সম্পর্কে। বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ হলে আল্লাহ তাআলা এতগুলো আয়াতে তার অবতারণা করেছেন। আমরা এখানে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করছি-

وَ مَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا لِیُطَاعَ بِاِذْنِ اللهِ.

আমি প্রত্যেক রাসূলকে কেবল এ লক্ষ্যেই পাঠিয়েছি, আল্লাহর হুকুমে তাঁর আনুগত্য করা হবে। -সূরা নিসা (৪) : ৬৪

قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ  وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

(হে নবী!) আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩১

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوا اللهَ وَ الْیَوْمَ الْاٰخِرَ وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِیْرًا.

বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ- এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করে। -সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

مَنْ یُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ اَطَاعَ اللهَ وَ مَنْ تَوَلّٰی فَمَاۤ اَرْسَلْنٰكَ عَلَیْهِمْ حَفِیْظًا.

যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যারা (তাঁর আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি (হে নবী!) আপনাকে তাদের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়ে পাঠাইনি (যে, তাদের কাজের দায়-দায়িত্ব আপনার উপর বর্তাবে।) -সূরা নিসা (৪) : ৮০

وَ مَنْ یُّطِعِ اللهَ وَ الرَّسُوْلَ فَاُولٰٓىِٕكَ مَعَ الَّذِیْنَ اَنْعَمَ اللهُ عَلَیْهِمْ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیْقِیْنَ وَ الشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیْنَ،  وَ حَسُنَ اُولٰٓىِٕكَ رَفِیْقًا، ذٰلِكَ الْفَضْلُ مِنَ اللهِ،  وَ كَفٰی بِاللهِ عَلِیْمًا.

যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সেইসকল লোকের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। কত উত্তম সঙ্গী তাঁরা!

এটা কেবলই আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্ব। আর (মানুষের অবস্থাদি সম্পর্কে) ওয়াকিবহাল হওয়ার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। -সূরা নিসা (৪) : ৬৯-৭০

وَ مَاۤ اٰتٰىكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَ مَا نَهٰىكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ شَدِیْدُ الْعِقَابِ.

রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর আর তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় করে চল। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। -সূরা হাশর (৫৯) : ০৭

এ আয়াত প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তাবেয়ী আলকামা রাহ. থেকে বর্ণিত-

عَنْ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: لَعَنَ اللهُ الوَاشِمَاتِ وَالمُوتَشِمَات،وَالمُتَنَمِّصَاتِ وَالمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ، المُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ، فَبَلَغَ ذَلِكَ امْرَأَةً مِنْ بَنِي أَسَدٍ يُقَالُ لَهَا أُمُّ يَعْقُوبَ، فَجَاءَتْ فَقَالَتْ: إِنَّهُ بَلَغَنِي عَنْكَ أَنَّكَ لَعَنْتَ كَيْتَ وَكَيْتَ، فَقَالَ: وَمَا لِي لا أَلْعَنُ مَنْ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَمَنْ هُوَ فِي كِتَابِ اللهِ، فَقَالَتْ: لَقَدْ قَرَأْتُ مَا بَيْنَ اللَّوْحَيْنِ، فَمَا وَجَدْتُ فِيهِ مَا تَقُولُ، قَالَ: لَئِنْ كُنْتِ قَرَأْتِيهِ لَقَدْ وَجَدْتِيهِ، أَمَا قَرَأْتِ: وَ مَاۤ اٰتٰىكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ  وَ مَا نَهٰىكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا؟ قَالَتْ: بَلَى، قَالَ: فَإِنَّهُ قَدْ نَهَى عَنْهُ.

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আল্লাহর লানত ঐসমস্ত নারীর প্রতি, যারা অন্যের শরীরে উল্কি অংকন করে ও নিজ শরীরে উল্কি অংকন করায় এবং যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রু-চুল উপড়িয়ে ফেলে ও দাঁতের  মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। এসব নারী আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি সাধনকারী।

তাঁর এ কথা আসাদ গোত্রের উম্মে ইয়াকুব নাম্নী এক মহিলার কাছে পৌঁছল। সে এসে বলল, আমি জানতে পেরেছি, আপনি এ ধরনের মহিলাদের প্রতি লানত করেন। ইবনে মাসউদ রা. বললেন, আমি কেন এমন লোকদের প্রতি লানত করব না, যাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন এবং যাদের কথা আল্লাহর কিতাবে আছে? মহিলাটি বলল, আমি তো দুই ফলকের মাঝে যা আছে (অর্থাৎ সম্পূর্ণ কুরআন) পড়েছি; কিন্তু আপনি যা বলছেন সেটা তো পাইনি। তিনি বললেন, তুমি যদি (ভালোভাবে বুঝে-শুনে) পড়তে তবে অবশ্যই পেতে। তুমি কি পড়নি-

وَ مَاۤ اٰتٰىكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ  وَ مَا نَهٰىكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا.

(অর্থাৎ রাসূল যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর আর যা বারণ করেছেন তা থেকে বিরত থাক।)?

মহিলাটি বলল, হাঁ। বললেন, তিনিই তো নিষেধ করেছেন এ থেকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৫

যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে ‘কুরআনে নেই’ বলে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের জন্য এই ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে।

দেখুন, কথার শেষ নেই। না মানতে চাইলে কত অজুহাতই তো মানুষ দাঁড় করায়। তবে হক গ্রহণের ইচ্ছা থাকলে এবং সত্যটা কী তা বোঝার আগ্রহ থাকলে, যেটুকু আলোচনা করা হল, ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট হবে।

আমাদের করণীয়

আল্লাহ তাআলা বলেন-

قُلْ اِنَّ اللهَ یُضِلُّ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ اَنَابَ.

(হে নবী!) আপনি বলে দিন, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন আর তাঁর পথে কেবল তাকেই আনয়ন করেন,  যে (তাঁর) অভিমুখী হয়। -সূরা রা‘দ (১৩) ২৭

তাই কুরআনের এই দুআটি আমরা বেশি বেশি পাঠ করি-

                                                                         رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً  اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.                           

হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে যখন হেদায়েত দান করেছেন, তারপর আর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং একান্তভাবে নিজের পক্ষ থেকে আমাদের রহমত দান করুন। নিশ্চয়ই আপনিই মহাদাতা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯

আর যারা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। হাতে-পায়ে ধরে হলেও বোঝাই। দেখুন, বিষয়টা অনেক গুরুতর। কিছু বিষয় এমন, যাতে দলীলের আলোকে ইমামগণের মাঝে একাধিক মত হতে পারে। এটা সে ধরনের বিষয় নয়। এটা তো ঈমান-কুফরের বিষয়। এটা ঈমান আর ওটা কুফর। এটা হেদায়েত আর ওটা গোমরাহী। কিন্তু তারা ভুল বুঝেছে অথবা কেউ তাদের কুমন্ত্রণা দিয়েছে; কোনো একটা সমস্যা তাদের হয়েছে। সেজন্য হাতে-পায়ে ধরে হলেও তাদের ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। দুআ করতে হবে, বোঝাতে হবে এবং আলেম-উলামার মজলিসে নিয়ে যেতে হবে। এরপর তারা নিজেরাও যদি নিজেদের জন্য দুআ করেন এবং সত্যটা বোঝার চেষ্টা করেন, আশা করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের হেদায়েত দান করবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন এবং সিরাতে মুসতাকীমের উপর অবিচল রাখুন- আমীন।

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك.

টীকা :

১. এখানে কট্টরপন্থী আহলে হাদীসের কথা বলা হয়েছে, যারা ফিক্হ ও ফুকাহায়ে কেরামের অবমাননা করে। ‘আহলে হাদীস’ বলতে মূলত বোঝানো হয়, ‘হাদীস’-এর আমানত ধারণকারী  হাদীসের হাফেযগণ এবং হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিতগণকে। এই নাম উক্ত ফেরকার লোকেরা নিজেদের জন্য অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে। তবে হাঁ, এই ফেরকার সকলের ভ্রান্তি একপর্যায়ের নয়। কারণ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত থেকে বিচ্ছিন্নতা তাদের সকলের একরকম নয়। এখানে তাদের আলোচনা এসেছে, নামের ভুল ব্যবহার এবং নামের মধ্যে নিজেদের মন্দ দিকটি উহ্য রাখা প্রসঙ্গে।

২. الصَّلٰوةِ الْوُسْطٰی  অর্থ মধ্যবর্তী সালাত। মধ্যবর্তী সালাত বলতে কী উদ্দেশ্য- সেটা কুরআনে নেই। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানিয়েছেন। এরপর তিনি সেটা তাঁর হাদীসের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন। সামুরা ইবনে জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

صَلَاةُ الوُسْطَى صَلَاةُ العَصْرِ.

মধ্যবর্তী সালাত হল, আসরের সালাত। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮১

قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ.

৩. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো জীবনই তো ছিল কুরআন অনুসরণ। সা‘দ ইবনে হিশাম ইবনে আমের রাহ. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বললেন-

أَلَسْتَ تَقْرَأُ الْقُرْآنَ؟

তুমি কি কুরআন পড় না?

বললেন, পড়ি। আয়েশা রা. বললেন-

فَإِنّ خُلُقَ نَبِيِّ اللهِ صَلَى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ الْقُرْآنَ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র তো ছিল কুরআন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৪৬

অর্থাৎ কুরআনই ছিল তাঁর আদর্শ। কুরআনের বাস্তবরূপই ফুটে উঠেছিল তাঁর জীবন ও চরিত্রে।

৪. আজকাল অনেকে কুরআন-সুন্নাহর ইলমকে হালকা মনে করেন। ভাবেন, গবেষণার জন্য ভাষাটাই কেবল আড়াল। ভাষাটা জানতে পারলে কিংবা অন্তত কোনো অনুবাদগ্রন্থ সংগ্রহ করতে পারলে আর কোনো সমস্যা নেই। এটা একদম ভুল চিন্তা। এ সম্পর্কে মাসিক আলকাউসারের মুহাররম ১৪২৬হি.  (ফ্রেব্রুয়ারি ২০০৫) সংখ্যায় ‘গবেষণা : অধিকার ও নীতিমালা’ শিরোনামে বান্দার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে সেটি ‘নির্বাচিত প্রবন্ধে’ (খ. ১, পৃষ্ঠা ২৪১-২৪৯) ছাপা হয়।

সাহাবায়ে কেরামের চেয়ে ভালো আরবী কে জানে? অথচ তাঁরাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অল্প অল্প করে কুরআন মাজীদ শিখতেন। তাবেয়ী আবু আবদুর রহমান আসসুলামী রাহ. বলেন-

حَدَّثَنَا مَنْ كَانَ يُقْرِئُنَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُمْ كَانُوا يَقْتَرِئُونَ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ آيَاتٍ، فَلَا يَأْخُذُونَ فِي الْعَشْرِ الْأُخْرَى حَتَّى يَعْلَمُوا مَا فِي هَذِهِ مِنَ الْعِلْمِ وَالْعَمَلِ، قَالُوا: فَعَلِمْنَا الْعِلْمَ وَالْعَمَلَ.

আল্লাহর রাসূলের যে সকল সাহাবী আমাদেরকে কুরআন পড়াতেন, তাঁরা বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁরা দশ আয়াত করে পড়তেন। দশ আয়াতের ইলম ও আমল শেখা শেষ না হলে অন্য দশ আয়াত শুরু করতেন না। তাঁরা বলেন, আমরা ইলম ও আমল উভয়টা শিখেছি। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩০৫৪৯; তাবাকাতে ইবনে সা‘দ, খ. ৬ পৃষ্ঠা ৪৪৯; শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবী, হাদীস ১৪৫১

প্রখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন-

عَرَضْتُ الْمُصْحَفَ عَلَى ابْنِ عَبَّاسٍ مِنْ فاتحتِهِ إِلَى خَاتِمَتِهِ أُوقِفُهُ عَلَيْهِ عِنْدَ كُلِّ آيَةٍ مِنْهُ، وَأَسْأَلُهُ عَنْهَا.

আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সামনে মুসহাফ (কুরআন) রেখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। প্রতি আয়াতে তাঁকে প্রশ্ন করেছি। -আলমুজামুল কাবীর, তাবারানী, হাদীস ১১০৯৭; ফাযায়েলুস সাহাবা, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, খ. ২ পৃষ্ঠা, ৪৯৯

এই হল সাহাবা-তাবেয়ীনের কুরআন শেখার পদ্ধতি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক দান করুন- আমীন।

৫. মনে রাখতে হবে, মুমিনদের পথ রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ ও শিক্ষার বাইরে কিছু নয়। মুমিনদের পথ তো রাসূলুল্লাহর শিক্ষা মোতাবেকই। তাঁর শিক্ষার উপরই মুমিনরা প্রতিষ্ঠিত। এজন্য সকল মুমিন যে পথে সে পথ ভুল হতে পারে না। কাজেই কেউ এ পথ থেকে বিচ্যুত হলে তার গোমরাহি নিশ্চিত।


মাসিক আলকাউসারের সৌজন্যে...