| |
               

মূল পাতা আরো পাঠকের কলাম পতনকালে উলামাদের নেতিবাচক ভূমিকার ইতিহাস


পতনকালে উলামাদের নেতিবাচক ভূমিকার ইতিহাস


সৈয়দ শামছুল হুদা     21 August, 2022     12:43 PM    


উসমানী খেলাফতের সমসাময়িক ৩টি এলাকায় মুসলমানদের দাপুটে উপস্থিতি ছিল। তারমধ্যে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য, পারস্যে সাফাভি বংশের রাজত্ব ও তুরস্ককেন্দ্রিক উসমানী খেলাফত। ৩টি মহাদেশে তখন মুসলমানদের প্রভাব ছিল। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা। সবগুলো এলাকায় মুসলমানদের আধিপত্য ছিল দাপুটে। কিন্তু অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ক্রুসেড যুদ্ধের আলো-বাতাস পেয়ে পাশ্চাত্য যখন মুসলিম সংস্কৃতির সন্ধান পেলো, ওরা যখন মুসলিম এলাকাগুলোর জ্ঞান রাজ্যের সন্ধান পেলো, তখন তারা কৌশল পাল্টে সম্মুখ সমর থেকে পিছন সরে মুসলমানদের ভেতর থেকে পতনের পথ ধরলো। 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে নিয়ে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে তারা সক্ষম হলো। ১৮৫৭সালের সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে মোগলদের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটলো ভারতবর্ষে, ১৯২৩সালে পতন ঘটলো উসমানী সম্রাজ্যের, কাছাকাছি সময়ে  পতন ঘটলো পারস্যের সাফাভি বংশেরও। মুসলমানদের মুলধারাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পাশ্চাত্য শক্তি সফল হলো। এরপর দেশে দেশে মুসলমানরা নামকাওয়াস্তে ক্ষমতায় থাকলেও তারা সকলেই বর্তমানে পাশ্চাত্যের আদর্শিক গোলাম। আর এই গোলামদের চোখের সামনেই একেক সময় একেক দেশকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। 

এই ৩টি অঞ্চলে সত্যিকার মুসলিম শাসকদের যখন পতনকাল শুরু হয়, তখন সেই সব এলাকার মুসলিম নেতাদের ভূমিকা ছিল আরো করুণ। আব্বাসী খেলাফতের পতনের সময়ে ঐ সময়কার আলেমদের ভূমিকা ছিল বড় লজ্জাস্কর। পতন মানে হলো, আগে সুখে ছিল। আরামে ছিল। উলামায়ে কেরাম সুখে-শান্তিতেই ছিলেন। কোনো ধরনের জিহাদ বা সংগ্রাম তাদের করতে হতো না। তারা বিলাসী জীবন যাপনই করছিলেন। যখন ইসলামের শত্রুরা আষ্ট্রে-পৃষ্ঠে বিধে ফেলছিল মুসলমানদের নানা দিক দিয়ে, তখন সেই সব এলাকার আলেম সমাজ পরম সুখে নিজেদের সাজানো আঙ্গিনায় তর্কে-বিতর্কে দিনাতিপাত করছিল।

উলামায়ে কেরাম জাতির পাহারাদারির দায়িত্ব পালন না করলে, সেই জাতির পতন ঠেকানো কঠিন হয়ে যায়। উলামায়ে কেরাম সরাসরি কখনো রাষ্ট্র পরিচালনা করেনি বটে, কিন্তু শাসকরা সবসময় সমকালীণ উলামাদের খুব ভয় করতেন। তাদের চোখ রাঙ্গানিকে তারা খুব সমীহ করতেন। কিন্তু শাসকদের দুর্বলতার সাথে সাথে দেখা যেতো সেই সময়কার আলেম সমাজও পতনের চরম গহ্বরে বাস করছে।  জাতিকে রাহবারি প্রায়শই করতে পারেনি। এজন্য উসমানী খেলাফতের পতন কালে উলামাদের ভূমিকা ছিল বড় নিন্দনীয়। এক এলাকার আলেম অন্য এলাকার আলেমদের সাথে ফতোয়া নিয়ে, নানা খানকাকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে লড়াই ও তর্কে লিপ্ত। জাতীয় স্বার্থের দিকে তাদের ফিরে তাকানোর সময়ও মিলতো না। রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যস্ত রাখতো। সুখে থেকে নানা ফতোয়া দিতো। নানা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অহেতুক বিতর্কছড়াতো। 

বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে এদেশের মুসলমানরা এখনো যথেষ্ট নিরাপদ আছে। কিন্তু সেই নিরাপত্তা বেষ্টনি যে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে এ নিয়ে এদেশের আলেম সমাজের মধ্যে কোনো ধরনের কৌতুহল দেখা যায় না। তারা এসব বিষয় বুঝে বলেও মনে হয় না। বিগত এক যুগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা  যে অন্যদের হাতে বন্দি হয়ে যাচ্ছে, আয়না ঘর, গুমরাজ্যে প্রবেশ ইত্যাদি বিষয় দেখেও আলেম সমাজকে এসব বিষয় ভাবাচ্ছে না। সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকভাবে যখন একটি স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই ভারতবর্ষের সরকারের কাছে ক্ষমতায় টিকে থাকার আকুতি প্রকাশ করেন, তারপরও কি বুঝার বাকী থাকে, দেশের স্বাধীনতার রশি কার হাতে? কোথায় ক্ষমতায় টিকে থাকার উৎস? অন্যের হাতের বিকিয়ে দিয়েছে তা কি এখনো বুঝতে অক্ষম? অথবা এখনো কি হুঁশ আসার সময় হয়নি আলেম সমাজের? 

বর্তমানে দেশের আলেম সমাজের মধ্যে জাতীয় বিষয়ে কথা বলার গুরুত্ব একেবারেই হ্রাস পেয়েছে। বরং অনেক বড় বড় স্কলারকে দেখি এমন সব ফালতু মাসআলা নিয়ে আলোচনা করতে যেগুলো একেবারেই তুচ্ছ বিষয়। পারস্পরিক রেষারেষি, কাদা ছুড়াছুঁড়িতে যে তৃপ্তি আমরা পাই, জাতীয় ইস্যুতে কথা বলে আলেম সমাজ মোটেও তৃপ্তি অনুভব করেন না। উলামায়ে কেরাম একটি নিরাপদ বেস্টনির ভিতর দিনাতিপাত করছেন। মহাসুখে আছেন। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা গোল্লায় যাক এসব নিয়ে ভাববার কাজ আমাদের না, এমনটাই মনে হয়।

আমরা অতীতের মতোই ভূমিকা গ্রহণ করছি। তাসবীহের দানা ছিড়ে গেলে যেমন সেটাকে আর ঠেকানো যায় না, আমাদের যেন এমনি অবস্থা হয়ে গেছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশের পতনকাল পুর্ব যে অবস্থাটা তৈরি হয়, ইতিহাসে যা পাওয়া যায়, ঠিক তেমনটাই এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান। আফগানিস্তানে যখন রুশ সেনারা ঢুকে, ঠিক বাংলাদেশের মতোই অবস্থা ছিল সেই দেশের আলেম সমাজের। চূড়ান্ত পতনের আগ পর্যন্ত জাতীয় বিষয় নিয়ে সেই দেশের আলেম সমাজ কথা বলেননি। সাহস নিয়ে ‍রুখে দাঁড়াননি। যা হবার তাই হযেছে। আজ তাদের সুদিন এসেছে। কিন্তু একাধারে প্রায় ৫০টি বছর তাদের রক্ত দিতে হয়েছে। তাদের অনেকগুলো প্লাসপয়েন্ট ছিল বলে, ভৌগলিক অসাধারণ সুবিধা ছিল বলে তারা নিজেদের উদ্ধার করতে পেরেছে। কিন্তু আরাকানের মুসলমানরা যেমন নিজেদের আর রক্ষা করতে পারেনি, বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে ভারতবর্ষের চূড়ান্ত সরকারের রূপরেখা প্রকাশ পেলে তখন আর উদ্ধার করার মতো কেউ থাকবে না। মুসলিম থাকবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে না। ভারতেও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মুসলিম আছে। কিন্তু !!!!!!!!

ওহে বিতর্ক প্রিয় ভাইয়েরা! একটু ডানে বামে তাকান। চোখ-কান খোলা রাখার চেষ্টা করেন। মরার আগেই মৃত্যুবরণ কইরেন না। এখনো সময় আছে। সব শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু শেষ হতে কতক্ষণ? 


লেখক : জেনারেল সেক্রেটারি,বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট-বিআইএম