রহমত ডেস্ক 01 March, 2022 08:34 PM
বাংলাদেশ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, জুনিয়র কোনো পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পেত পরিবার। তখন বিল পাস করত জেলা পুলিশ সুপার। সরকার ২০২০ সালে আট লাখ করার পর সেই বিল পাস করে জেলা প্রশাসকরা। এতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় মারা যায় ৩৭৭ পুলিশ সদস্য। এরমধ্যে মাত্র ৭৯ পরিবার টাকা পেয়েছে। বাকি সব পেন্ডিং। আমাদের জুনিয়র কোনো সদস্য যখন দায়িত্বরত অবস্থায় মারা যায় তখন পুরো পরিবার অথৈ সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়। জেলা প্রশাসকরা অনেক ব্যস্ত থাকেন। এই দায়িত্ব যদি আবারো পুলিশ সুপারদের কাছে যায় তাহলে এই সমন্বয়হীনতা থাকবে না। মৃত পুলিশ সদস্যদের অসহায় পরিবারগুলোর অনেক উপকার হবে। আশা করছি, এই অনিশ্চয়তা কাটাতে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় হবে।
আজ (১ মার্চ) মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজধানীর মিরপুর-১৪তে পুলিশ স্টাফ কলেজ (পিএসসি) কনভেনশন হলে আয়োজিত ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে’ উপলক্ষে ২০২১ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের প্রতি সম্মান জানিয়ে পুলিশ মেমোরিয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও তাদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব আখতার হোসেন। পুলিশ স্টাফ কলেজ (পিএসসি) কনভেনশন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ২০২১ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী ১৩৭ পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান করা হয়। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, আইজিপিসহ উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ ২০২১ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গ পুলিশ স্টাফ কলেজ চত্বরে নবনির্মিত পুলিশ মেমোরিয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
আইজিপি বলেন, শান্তিকালীন সময়ে যারা দুষ্কৃতিকারী, জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য লিপ্ত হয় তাদের বিরুদ্ধেই পুলিশই ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এই যুদ্ধ সন্ত্রাসী, অপরাধী, জঙ্গি, গ্যাং, চোর-ডাকাতদের বিরুদ্ধে। যারা শান্তিভঙ্গ কিংবা বিনষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। আমরা শান্তিকালীন সময়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছি দেশ, জনগণ, সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তার জন্য। এজন্য আত্মত্যাগ করছে পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ লাইন ডিউটিতে প্রাণ হারায়। প্রতিবছর শত শত সহকর্মীকে হারাই কর্তব্যরত অবস্থায়। ৩৪৬ জন পুলিশ সদস্যকে হারিয়েছি গত বছর। এরমধ্যে শুরু করোনার দুই বছরে আমরা ১০৬ জন পুলিশ সদস্যকে হারিয়েছি। আজ ১৩৮ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কমরেড, সহকর্মী, বন্ধু, কলিগ, প্রিয়মুখকে হারিয়েছি। শুধু সমবেদনা জানানো নয়। আমাদের বিরাট অনুরণন আছে, শোকাবহ অনুরণন রয়েছে। আমরা তাদের আত্মত্যাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ আমরা বীরের জাতি। বীরের আত্মত্যাগ আরও বীরের জন্ম দেবে। কেউ আহত হন, নিহত হন, মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস তাদের অবদানকে সর্বদা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রফেশনাল, জব সেফটি, সেফটি ইনভারমেন্ট আরও ভালো করার চেষ্টা করছি। যারা অসুস্থ হন তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদেই পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ৫ কোটি টাকার চেক দিয়ে এর যাত্রা শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত ২০০৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে ৫২ কোটি টাকা দিয়েছি। এবছরও পৌনে দুই কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য।
আইজিপি বলেন, গত দুই বছরে সবার সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালে পরিণত হয়েছে আমাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও বেশি সহযোগিতা সাপোর্ট প্রত্যাশা করছি। পুলিশের বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব ও কাজের পরিবেশের কারণে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ ধরনে রোগ হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, কিডনি, ক্যান্সার, হার্টের সমস্যা হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে ডায়ালাইসিস ইউনিট যুক্ত করেছি। যেখানে ১০০ থেকে ১৫০ কিডনি আক্রান্ত পুলিশ সদস্য ডায়ালাইসিস সুবিধা পাচ্ছেন। এসব রোগের চিকিৎসা আমাদের হাসপাতালে চলছে। ২৯৬ জন স্টাফ দিয়েছে সরকার। এর নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এটা সম্পূর্ণ হলে চিকিৎসার মান আরও বাড়বে। আমরা এ বছরই ক্যাথ ল্যাব (কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন) সংযুক্ত করছি। এর ফলে আর বাইরে যাওয়া লাগবে না হার্টের রোগীদের। ইন হাউজ রিং পরানো যাবে। আগামী বছরই ক্যান্সার ইউনিট চালু হবে। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। সিরিয়াস ব্যধির চিকিৎসা হবে। ক্যান্সার হলে ৫, ১০ ও ১৫ লাখে কিছু হয় না। এই টাকা খরচ না করে আমরা চিকিৎসার সার্বিক ব্যবস্থা করব। ঢাকা বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটি সম্পন্ন হলে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চাপ কমবে। ২ লাখ ১২ হাজার সদস্যের চিকিৎসা সম্ভব হবে আমাদের হাসপাতালেই। আড়াইশ বেডের এই হাসপাতাল এখন ১১৫০ বেডের। সেটা আরও ৫০০ বেড বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
পুলিশ বহুমুখী দায়িত্ব পালন করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে উন্নতি তাতে শিল্পায়ন নগরায়ণ হচ্ছে। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে৷ যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকছে বছরের পর বছর কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। মানুষ একা হয়ে পড়ছে৷ সেকারণেই বর্তমান অবস্থার মধ্যে এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেটা পুলিশের দায়িত্বের বাইরে। উন্নয়নের পেছনে আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ করি। শিল্প পুলিশ প্রতিষ্ঠার আগে এমন কোনো মাস ছিল যে আগুন লাগেনি। এখন কিন্তু মালিক বেতন না দিলে শিল্প পুলিশ সে ব্যবস্থা করছে। পাঁচটা মন্ত্রণালয় আমরা সিলেক্ট করেছি, যারা আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে পারি। রাষ্ট্র উপকৃত হবে। যদিও কারো কারো চক্ষুশূলের কারণ হচ্ছি। গ্রাম পর্যায়ে পুলিশিং এর সঙ্গে উন্নয়নের কাজে অংশ নিতে পারি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘পুলিশের কাজ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তা করতে না পারলে সোসাইটিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব সম্পর্কে অনেকে কিছু জানি না। ছোটখাটো ভুলত্রুটির কারণে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অথচ তাদের কর্মঘণ্টা, খাওয়া, পরিশ্রম বিবেচনা করি না। আমার মনে হয় তাদেরকে সম্মান সহানুভূতির সঙ্গে মনে রাখা উচিত। পুলিশ বাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রথম প্রতিরোধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল পুলিশ। পিলখানা হত্যাযজ্ঞেও প্রথম পুলিশ প্রতিরোধ গড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ আজ স্বাধীন। তিনি চেয়েছিলেন মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করবে। শোষণ বঞ্চনার কথা অনেক কবি-সাহিত্যিক লিখছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই প্রথম ঝাঁকুনি দিয়েছেন ভাষণের মাধ্যমে। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে দর্শন ছিল বঙ্গবন্ধুর সেটিই এখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার। সুতরাং, দেশ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সামাজিকভাবে আরও অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। নৈমিত্তিক দায়িত্বের পাশাপাশি একটি দিন ইউনিয়ন পরিষদে সমন্বয় করে বসেন। গ্রামের অবহেলিত মানুষকে এগিয়ে নিতে হবে। একা হয়তো অনেক কিছুই সম্ভব না। তবে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্ভব অনেক কিছুই। আউট অব দ্য বক্স, দায়িত্বের বাইরে জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। ইনোভেটিভ কাজে অগ্রগামী হতে হবে। ক্লাসে এখন জীবনমুখী কথাবার্তা হয় না। কীভাবে শিক্ষার্থীরা পাস করবে সেটাই মুখ্য থাকে। শুধু সার্টিফিকেটই জীবনের সবকিছু না, জীবনের মানে, দায়িত্ববোধ জানতে বুঝতে ও শিখতে হবে। আমরা অপরাধ ঘটলেই কেবল অপরাধীর পেছনে ছুটব! আমার মনে হয় প্রো-অ্যাকটিভ কিছু করতে হবে। যাতে অপরাধী অপরাধ কাজ থেকে বিরত থাকে। যেমন- কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, লোনের ব্যবস্থা করা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পুলিশের ১৯৯৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষের কারণে এবং কর্মরত অবস্থায় নিহত পুলিশ সদস্যদের সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১৭ সাল থেকে ১লা মার্চ মেমোরিয়াল-ডে পালন করছে। প্রতি বছর মেমোরিয়াল-ডেতে ওই বছরে মৃত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের উপস্থিতিতে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। মেমেরিয়াল-ডে পালন করার জন্য ইতোপূর্বে রেপলিকা স্মৃতি তৈরি করে পালন করা হয়েছে। জেলা/ইউনিটে একই দিনে রেপলিকা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে মেমেরিয়াল-ডে পালন করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান স্মৃতিস্তম্ভ পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১০ সালে স্থায়ী দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিজ্ঞ নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় নকশা প্রণয়ন ও সাইট নির্ধারণ করে ২০১৯ সালে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করা হয়। অনন্য এ স্থাপত্য নকশায় নির্মিত পুলিশ মেমোরিয়ালের বেদীর মোট আয়তন ২৮ হাজার ৩০০ বর্গ ফুট। প্রায় ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। বেদীর মাঝখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরের সম্মুখযোদ্ধা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর ৭১-এর অনুসরণে টাওয়ারটির উচ্চতা ৭১ ফুট নির্ধারণ করা হয়েছে। রাতের বেলায় টাওয়ার থেকে বিকিরিত আলো বীর শহীদদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।