| |
               

মূল পাতা ইসলাম জুমআর দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও আমাদের করণীয়


জুমআর দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও আমাদের করণীয়


মাওলানা রাদ তানবীর     14 January, 2022     02:02 PM    


মানবজাতিকে দেওয়া মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে একটি হলো সময়। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর এই পরিক্রমায় গেঁথে সৃষ্টি হয়েছে সময়ের সমষ্টি। সময়ের এই সমষ্টির মধ্যে আছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সেক্টর। আছে শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ বিভিন্ন মুহূর্ত, বিভিন্ন দিন ও বিভিন্ন মাস। তেমনি একটি হলো জুমআর দিন। জুমআর দিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মতের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক উৎকৃষ্ট ও অনন্য উপহার। মুহাম্মাদী উম্মতকে তিনি মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় তুলেছেন এই পবিত্র দিনটি দান করে। জুমআর দিন অবশ্যই এক পবিত্র বরকতময় দিন। জুমআর দিন মুসলিমদের জন্য ঈদ ও আনন্দের দিন। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি যত জাতি যত দিবস পালন করেছে তারমধ্যে শ্রেষ্ঠতম ও পবিত্রতম এই জুমুআর দিন। ইহুদিদের শনিবার আর খ্রিস্টানদের রবিবারের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রগামিতা ধরে আছে মুসলিমদের এই জুমআর দিন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 
نحْنُ الآخِرُونَ وَنَحْنُ السَّابِقُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بَيْدَ أَنَّ كُلَّ أُمَّةٍ أُوتِيَت الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِنَا وَأُوتِينَاهُ مِنْ بَعْدِهِمْ ثُمَّ هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْنَا هَدَانَا اللَّهُ لَهُ فَالنَّاسُ لَنَا فِيهِ تَبَعٌ الْيَهُودُ غَدًا وَالنَّصَارَى بَعْدَ غَدٍ 
অনুবাদ: আমরা সর্বশেষ উম্মত, কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরা হব অগ্রগামী। যদিও সকল উম্মতকে কিতাব দেয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আর আমাদের কিতাব দেয়া হয়েছে সকল উম্মতের শেষে। তারপর যে দিনটি আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন সেদিন সম্পর্কে তিনি আমাদেরকে সঠিক সন্ধান দিয়েছেন। সেদিনের ব্যাপারে অন্যান্যরা আমাদের পিছনে রয়েছে, যেমন ইয়াহুদিরা (আমাদের) পরের দিন (অর্থাৎ শনিবার) এবং খ্রিস্টানরা তাদেরও পরেন দিন (অর্থাৎ রবিবার), (সহীহ মুসলিম)।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত হুযায়ফা বিন ইয়ামান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 
أَضَلَّ اللَّهُ عَنِ الْجُمُعَةِ مَنْ كَانَ قَبْلَنَا فَكَانَ لِلْيَهُودِ يَوْمُ السَّبْتِ وَكَانَ لِلنَّصَارَى يَوْمُ الأَحَدِ فَجَاءَ اللَّهُ بِنَا فَهَدَانَا اللَّهُ لِيَوْمِ الْجُمُعَةِ فَجَعَلَ الْجُمُعَةَ وَالسَّبْتَ وَالأَحَدَ وَكَذَلِكَ هُمْ تَبَعٌ لَنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ نَحْنُ الآخِرُونَ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا وَالأَوَّلُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمَقْضِيُّ لَهُمْ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ
অনুবাদ: আল্লাহ আমাদের পূর্বে বিগতদেরকে জুমআর দিন সম্পর্কে সঠিক পথের সন্ধান দেননি। তাই ইয়াহুদিদের জন্য শনিবার এবং খ্রিস্টানদের জন্য রবিবার নির্ধারিত হয়েছে। এরপর আল্লাহ আমাদেরকে (পৃথিবীতে) আনলেন এবং আমাদেরকে জুমুআর দিনের সঠিক সন্ধান দিলেন। ফলে তিনি জুমআর দিন, শনিবার ও রবিবার এভাবে বিন্যাস করলেন। এভাবেই তারা কিয়ামতের দিন আমাদের পশ্চাদবর্তী হবে। আমরা পৃথিবীবাসীর মধ্যে শেষে আগমনকারী উম্মত এবং কিয়ামতের দিন হবো সর্বপ্রথম। যাদের সমগ্র সৃষ্টির আগে বিচার অনুষ্ঠিত হবে। (সহীহ মুসলিম)

সূর্য উঠেছে এমন দিবসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিন হলো জুমআর দিন। এই জুমআর দিনেই সৃষ্টি করা হয়েছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানুষ হযরত আদম আলাইহিস সালামকে। এদিনেই হযরত আদম আলাইহিস সালামকে প্রবেশ করানো হয়েছিল জান্নাতে। এদিনেই মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর মহান ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ، فِيهِ خُلِقَ آدَمُ وَفِيهِ أُدْخِلَ الْجَنَّةَ وَفِيهِ أُخْرِجَ مِنْهَا وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ
অনুবাদ: সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমআর দিন সর্বোত্তম। এ দিন (হযরত) আদম (আলাইহিস সালাম) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এদিন সেখান থেকে তাকে বের করা হয়েছে, আর এই জুমুআর দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। (সহীহ মুসলিম)

জুমআর দিনে আমাদের করণীয় কী:
আমাদের উচিত এই পবিত্র দিনটিকে বেশি বেশি নেককাজ, কুরআন তেলাওয়াত, সালাত, দোয়া, দুরূদ পাঠে কাটানো ও অন্যদিনের তুলনায় মসজিদে একটু আগে আগে যাওয়া, ইত্যাদি। এই জুমআর দিনটি যদি আমরা ভালো কাজে কাটাই তবেই তা হবে আল্লাহ তায়ালার এই মহান নেয়ামতের উপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। তাই আমাদের প্রত্যেকের উপরই কর্তব্য জীবনে যে কয়টি জুমুআর দিন আসে সবগুলোকে বেশি বেশি নেক আমল, কুরআন তেলাওয়াত, সালাত, ইস্তেগফার, দুরূদ পাঠ, ইত্যাদি দিয়ে রাঙানো। প্রতিটি জুমআর দিনকে জীবনের পরম পাওয়া ও গনীমত মনে করা উচিত। এই জুমুআর দিনের অনেক আমলের কথা প্রিয় নবীর বক্ষনিঃসৃত বাণীসমূহে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কিছু উল্লেখ করছি।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ (رض.) أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَكَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ : فِيهِ سَاعَةٌ لاَ يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ يُصَلِّي يَسْأَلُ اللَّهَ شَيْئًا إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهُ
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমুআর দিনের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, তাতে এমন একটি মুহূর্ত আছে যখন কোন মুসলিম বান্দা সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করলে অবশ্যই তিনি তাকে তা দান করেন। (সহীহ মুসলিম)

وعَنْ أَوسِ بنِ أَوسٍ (رض.) قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللّٰهُ صَلَّى اللّٰهُ عَليْهِ و سَلَّمَ: إِنَّ مِنْ أَفْضَلِ أَيَّامِكُمْ يَومَ الجُمُعَةِ فَأَكْثِرُوا عَلَيَّ مِنَ الصَّلاةِ فِيهِ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ مَعْرُوضَةٌ عَلَيَّ الخ.
অনুবাদ: হযরত আওস ইবনে আওস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিঃসন্দেহে তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুমআর দিন। সুতরাং ঐ দিন তোমরা আমার উপর অধিকমাত্রায় দরূদ পড়। কেননা, তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়। (সুনানে আবু দাউদ)

عَنْ أَبيْ هُرَيْرَةَ قال قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللّٰهُ عليه و سَلّمَ: إِذَا كَانَ يَوْمُ الْجُمُعَةِ كَانَ عَلَى كُلِّ بَابٍ مِنْ أَبْوَابِ الْمَسْجِدِ مَلاَئِكَةٌ يَكْتُبُونَ الأَوَّلَ فَالأَوَّلَ فَإِذَا جَلَسَ الإِمَامُ طَوَوُا الصُّحُفَ وَجَاءُوا يَسْتَمِعُونَ الذِّكْرَ وَمَثَلُ الْمُهَجِّرِ كَمَثَلِ الَّذِى يُهْدِى الْبَدَنَةَ ثُمَّ كَالَّذِى يُهْدِى بَقَرَةً ثُمَّ كَالَّذِى يُهْدِى الْكَبْشَ ثُمَّ كَالَّذِى يُهْدِى الدَّجَاجَةَ ثُمَّ كَالَّذِى يُهْدِى الْبَيْضَةَ
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমআর দিন এলে মসজিদের প্রত্যেক দরজায় ফিরিশতা খাড়া হয়ে যান। তারপর তাঁরা প্রথম, দ্বিতীয় লিখতে থাকেন। পরিশেষে যখন ইমাম মিম্বরে বসেন তখন তাঁরা খাতা গুটিয়ে দেন এবং খুতবা শুনতে (মসজিদের ভিতরে) এসে যান। আর যে সকাল-সকাল আসে তার উপমা উট কুরবানীদাতার মতো, তারপরে যে গাভী কুরবানীদাতার মতো, তারপরে যে মেষ কুরবানীদাতার মতো, তারপরে যে মুরগী কুরবানীদাতার মতো, তারপরে যে ডিম কুরবানীদাতার মতো। (সহীহ মুসলিম)


এমন আরও বহু বর্ণনা রয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র বাণীতে। কাজেই আমাদের উচিত তাঁর এই বাণীগুলো ফলো করে জুমআর দিনের কর্মসূচি সাজানো এবং সে অনুযায়ী আমল করে ছওয়াবের পরিধিকে সমৃদ্ধ করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বুঝার তাওফীক দান করুন।

লেখক : আলেম ও মুদাররিস।