| |
               

মূল পাতা মুসলিম ঐতিহ্য উস্তাযুল উলামা মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ.


উস্তাযুল উলামা মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ.


মুফতি জসিম উদ্দিন ফেনবী     16 October, 2021     02:53 PM    


অর্ধ শতাব্দী থেকে বেশি ফেকাহ এবং দারস- তাদরীসে পূর্ণ সততার সঙ্গে ও ইলমে নববীর আলো বিচ্ছুরণকারী প্রভাবশালী ইলমি ব্যক্তিত্ব উস্তাদে মুহতারাম মুফতীয়ে আযম বাংলাদেশ ও সাবেক প্রধান মুফতি জামেয়া উলূমুল ইসলামিয়া বানুরী টাউন করাচী-হজরতুল আল্লাম মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. আমাদেরকে এতিম করে চলে গেছেন। হাদীস এবং ফিকহের এক কূলহীন সমুদ্র আমাদের থেকে দূরে সরে গেলো। ইলম ও আমল, যুহুদ এবং তাকওয়ার সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে।

মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ.-কে আল্লাহ তাআলা অনেক গুণে সমাহার করেছেন। তিনি একসঙ্গে মুহাদ্দিস, ফকীহ, দক্ষ উস্তাদ, লেখক এবং অত্যন্ত দয়াবান একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর গুণসমূহকে যদি একদল মানুষ অর্জন করে নেয়, তাহলে সবাই পূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবে। মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে উলামায়ে কেরামকে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
 
তিনি সমকালীন বিশ্বের আকাবীরদের মধ্য হতে ছিলেন। যার কারণে দারস-তাদরীসের আসন এবং ইলমে ফিকহের মসনদ গর্ববোধ করতো। যার ইলম ও ধৈর্যের কারণে মহান প্রভু নিজ বান্দাদের ওপর দয়ার বৃষ্টি বর্ষণ করেন। যার অনাড়ম্বর জীবন-যাপন আসলাফদের কথা স্বরণ করিয়ে দেয়।

জন্ম ও বংশ :
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ শহর চট্টগ্রামের 'নলদিয়া' গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে ১৩৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৯৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বংশপরিক্রমা এভাবে- মুহা. আব্দুস সালাম বিন শেখ সূফী খলিলুর রহমান বিন শেখ আ. খালেক বিন শেখ রওশন আলী।

শিক্ষাজীবন ও অধ্যাপনা :
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত আযিযিয়া কাসেমুল উলূম মাদরাসায় সমাপ্ত করেন। তারপর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য বাবুনগর মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে চারবছর পর্যন্ত থেকে শরহে বেকায়া, শরহে জামীর মত দুর্বোধ্য কিতাবাদি পাঠ করেন। অতঃপর জিরি মাদরাসায় হেদায়া থেকে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন চারবছরে। ছাত্রাবস্থায় তিনি প্রতিটি ক্লাসে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

১৯৬৭ সালে তিনি জামেয়া উলূমুল ইসলামিয়া বানুরী টাউন করাচীতে আসেন এবং যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাও. সাইয়্যেদ ইউসুফ বানুরী রহ. এর তত্ত্বাবধানে থেকে পুনরায় দাওরায়ে হাদীস পড়েন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ঈর্ষনীয় ফলাফল অর্জন করেন।

তিনি মাওলানা ইউসুফ বানুরী রহ. এর বিশেষ ছাত্রদের মধ্য হতে ছিলেন। সেখানেই তিনি ইফতায় ভর্তি হন। পাকিস্তানের গ্র্যান্ড মুফতি মাও. ওলি হাসান টুংকী রহ. এর পরশে থেকে অত্যন্ত পরিশ্রম ও সফলতার সঙ্গে ইলমে ফিকহের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেন। আরবি ভাষায় তাঁর থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল :بيع الحقوق في التجارات الرائجة اليوم و تحقيقها অর্থাৎ: প্রচলিত ব্যবসা স্বত্ব বিক্রি ও তার পর্যালোচনা।

এই থিসিস (অভিসর্ন্দভ) সম্পর্কে সমকালীন যুগের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাও.আব্দুর রশিদ নুমানী রহ. বলেছেন : ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী থিসিস। এই অভিসন্দর্ভই প্রমাণ করে তাঁকে ইলমে ফিকহের উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা যায়।’

যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হজরত মাও.ইউসুফ বানুরী রহ., মাও. মুহাম্মদ ইদরীস মিরাঠী ও মুফতি ওলি হাসান টুংকী রহ. এর পরামর্শক্রমে তাঁকে এ জামিয়ায় মুদাররিস ও সহকারী মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেন। যখন মাও. মুফতি আহমাদুর রহমান সাহেব রহ. নায়েবে মুফতি ও মুফতি ওলি হাসান টুংকী রহ. প্রধান মুফতি পদে ছিলেন।

মাওলানা ইউসুফ বানুরী রহ. এর পরলোকগমনের পর মুফতি আহমাদুর রহমান সাহেব মহাপরিচালক নিযুক্ত হলে তিনি নায়েবে মুফতি পদে অধিষ্ঠিত হন এবং দারুল ইফতায় লিখিত ফতোয়া সংশোধনী করতেন। এরপর মুফতি ওলি হাসান টুংকী রহ. এর ইন্তেকালের পর তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ দারুল ইফতার প্রধান মুফতি পদে সমাসীন ছিলেন।

উস্তাদবৃন্দ :
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. এর প্রসিদ্ধ কয়েকজন উস্তাদ হলেন : মাও.আব্দুল ওয়াদুদ রহ. (শায়খুল হাদিস জিরি মাদরাসা ও শাগরিদে খাস মাও.মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ., মাও.আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ., আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ., মুফতি ওলি হাসান টুংকী রহ., মাও. ইদরীস মিরাঠী রহ., মাও. ফজলে মুহাম্মদ সুওয়াতি রহ., মাও. হামেদ রহ. ও মাও. হারুন রহ. (বাংলাদেশ)

ছাত্রবৃন্দ :
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত দারস-তাদরীসে লিপ্ত ছিলেন, তাই পুরো পৃথিবীতে যেখানে মুসলিম বসতি রয়েছে সেখানে হজরতের ছাত্রবৃন্দ পাওয়া যায়। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, আরব থেকে ইরান, আফগানিস্তান সর্বত্র হজরতের ছাত্রদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যারা ইলমে নববী বিতরণের কাজে রত আছেন।

কর্ম :
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. এর মূল কাজ ছিল ঐ সমস্ত হাজার হাজার ফতোয়া; যা ষাটের অধিক রেজিস্ট্রার খাতায় নথিবদ্ধ রয়েছে। তিনি সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রতিদিন সংঘটিত বিষয়ে ফতোয়া লিখতেন ও সেগুলো সত্যায়ন করতেন।
ইমামে আহলে সুন্নাত মুফতি আহমাদুর রহমান রহ. বলেছিলেন : ‘মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী লিখিত ফতোয়ায় অনেক উচ্চস্তর অর্জন করে ফেলেছেন।’

রচনাবলি :
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. উর্দু ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন, এগুলোর মধ্যে-

১-ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে মানব অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয়।
২- ইসলামি মাঈশাত কে বুনিয়াদি উসূল (উর্দু)
৩- আপকে সুওয়ালাত আওর উনকা হল (উর্দু)
৪- জাওয়াহেরুল ফাতাওয়া ৬ খণ্ড
৫- ইসলাম মেঁ আওলাদ কি তারবিয়ত আওর উসকে  হুকুক (উর্দু)
৬- আকেলা কি শরঈ হায়ছিয়াত (উর্দু)
৭- রহমতে আলম সা, এর মকবুল দোয়া (উর্দু বাংলা)
৮ - মাআরেফে সুলতান (উর্দু)
৯- মাকালাতে চাটগামী (উর্দু)
১০- হায়াতে শাইখুল কুল (উর্দু)
১১-তাজকেরায়ে মুখাল্লাস (উর্দু)
১২- করোনা ভাইরাস আওর উসকি শরউ হাইছিয়াত (উর্দু) ইত্যাদি।


মুফতিয়ে আযম উপাধি লাভ :
দারস-তাদরীস হজরতের প্রধান কাজ ছিল, তাই পড়ানোর সময় এত মনোযোগী ছিলেন যে, অন্য কোনো বিষয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতেন না। যেন দারস-তাদরীসের সাগরে ডুবন্ত ছিলেন। মাও. ইদরীস মিরাঠির পর এই উদ্দীপনা হজরতের দরসে পাওয়া যেতো। মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. ২০০০ সালে পারিবারিক প্রয়োজন ও অসুস্থতার কারণে করাচীর নিউটাউন মাদরাসা থেকে অব্যাহতি নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং হাটহাজারী মাদরাসায় জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দারস-তাদরীস ও ফতোয়ার কাজে মনোনিবেশ ছিলেন।

বাংলাদেশের মুফতিয়ে আযম মুফতি আহমাদুল হক রহ. এর ইন্তেকালের পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সমস্ত উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে ‘মুফতিয়ে আযম’ স্বীকৃতি প্রদান করেন।

ইসলাহী সম্পর্ক :
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী রহ. এর ইসলাহী সম্পর্ক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আকাবিরের সঙ্গে ছিল। তন্মধ্যে : শাহ আবদুল আজিজ রায়পুরী রহ., মাও. ইয়াহইয়া ভাউলনগরী রহ., মাও. শাহ সুলতান নানুপুরী রহ.ও মুফতি আহমাদুল হক রহ. প্রমুখ।

মৃত্যু ও জানাযা :
গত ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে বুধবার সকাল ১১টায় এই মহামনীষী পরলোকগমন করেন। হাটহাজারী মাদরাসায় জানাযা শেষে জামিয়ার মাকবারায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। হজরতের জানাযায় দেশের বড় বড় উলামায়ে কেরামসহ হজরতের ছাত্র ও ভক্তবৃন্দ এবং জনসাধারণের ব্যাপক উপস্থিতি হয়। আল্লাহ তাআলা উস্তাদে মুহতারামের সঙ্গে সন্তুষ্টমূলক আচরণ করুন এবং আমাদের সকলকে মুফতিয়ে আযমের পদাংক অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। তাঁর ফয়েজ ও বরকত থেকে আমাদেরকে মাহরুম করবেন না। আমিন সুম্মা আমিন।

পাকিস্তানের দৈনিক ‘উর্দু জং’ পত্রিকা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।
অনুবাদক : মুফতিয়ে আযমের বিশেষ ছাত্র ও শিক্ষক, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গীরচর ঢাকা।