| |
               

মূল পাতা জীবনযাপন ‘সাফল্যের বই’ কেন জনপ্রিয়


‘সাফল্যের বই’ কেন জনপ্রিয়


প্রবাল আহমেদ     21 June, 2021     01:18 PM    


Self Development জাতীয় বইগুলো আজকাল বেশ জনপ্রিয়। এসব বইয়ের বেচাবিক্রি ভালো; এই ধরনের বই পাবলিশ করায় আজকাল প্রকাশকদের আগ্রহও বেশি।

এ ধরনের বইয়ের মূল গুরু ছিলেন ডেল কার্নেগি। তার বই সারা পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে, বহু লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। এরপর আধুনিক যুগে এসে এই তালিকায় আরো বেশ কিছু নাম যুক্ত হয়েছে। শিব খেরা, ব্রায়ান ট্রেসি - এরা সবাই মোটামুটি জনপ্রিয়।

এসব বইয়ের কিছু কমন বিষয়বস্তু আছে - সফল হওয়ার উপায়, সুখী হওয়ার সহজ পথ, ধনী হওয়ার কৌশল - ইত্যাদি ইত্যাদি। বইয়ের শিরোনাম দেখলে মনে হতে পারে - এর একখানা বই পড়লেই আপনি তরতর করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাবেন। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের এসব বইয়ের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ থাকে।

এসব বইতে খুব সাধারণ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয় - " কঠোর পরিশ্রম করতে হবে",  " আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে ", "সাহসী হোন " - এগুলোই এসব বইয়ের মূল কথা। এ ধরনের উপদেশের পাশাপাশি এসব বইতে কিছু গল্প থাকে। পাঠকরা পড়ে উজ্জীবিত হয়। শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কতটুকু হয় সেটা অবশ্য বলা কঠিন।

এই ধরনের বইয়ের একটা মূল সমস্যা হলো - কথাবার্তাগুলো অনেক বেশি superficial. এসব লেখকরা সমাজ, সভ্যতা এবং রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে কিছু সস্তা পরামর্শ দিয়ে পাঠকদের মন জয় করতে চায়।

একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। এযুগের কোন বইয়ে সাধারণত বিল গেটস বা স্টিভ জবসের কথা উল্লেখ থাকে। তাদের সাফল্যের গল্প বলে পাঠকদের আকৃষ্ট করা হয়। কিন্তু এই ধরনের লেখকরা কখনও বলেন না যে মার্কিন পুঁজিবাদ এভাবে মাথা তুলে না দাঁড়ালে বিল গেটস বা জাকারবার্গ কখনো তৈরি হতো না। এই সব তথাকথিত সফল মানুষেরা একটি রাষ্ট্রীয় - অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাই-প্রোডাক্ট। এরা সবাই মেধাবী মানুষ, এদের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব অবশ্যই আছে - কিন্তু এদের সাফল্যের পেছনে আছে মার্কিন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থাটি এরকম মানুষ তৈরি করে।

এই ধরনের বইয়ে সফল মানুষ হিসেবে বিল গেটস বা জাকারবার্গের কথাই থাকবে; কিন্তু গ্রামের একজন নিষ্ঠাবান স্কুল শিক্ষকের কথা কখনো থাকবে না। কারণ বর্তমান বাস্তবতায় এরকম একজন শিক্ষক সফল মানুষ  নন। আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায়, এই পাঠকরা বিল গেটস হয়ে ওঠার পথ খুঁজছে; গ্রামে গিয়ে শিক্ষক হওয়ার আগ্রহ তাদের নেই।

এসব বইয়ে এ প্রশ্ন কখনো আলোচনা হবে না যে, সমস্ত সফল মানুষ শুধু ইউরোপ আমেরিকায় কেন? কেন আফ্রিকা থেকে আমরা কোন সফল মানুষের উদাহরণ পাই না। এসব বইয়ের পাঠকরা জানতে পারবে না যে, বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আফ্রিকাকে মাথা তুলতে দেওয়া হয়নি; বরং পুরো একটা জাতিকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এসব বই কখনো আলোচনা করে না যে নিম্নবিত্তের মানুষ সীমাহীন পরিশ্রমের পরও কেন সাফল্যের দেখা পায় না। সেল্ফ ডেভেলপমেন্ট বইয়ের লেখকেরা শুধু বিল গেটস আর স্টিভ জবসের কথাই বলতে আগ্রহী, তারা সক্রেটিসের কথা বলতে রাজি নয়। ব্যক্তি মানুষের সুখ সমৃদ্ধির পেছনে যে রাজনীতি ক্রিয়াশীল থাকে - তার কথা বলতে রাজি নয়। এদের বেশিরভাগের সে যোগ্যতাও নেই। এসব বইয়ের লেখকেরা কখনো স্বীকার করে না যে, শতকরা ৯০ জন মানুষকে বঞ্চিত করেই বাকি ১০ ভাগ মানুষ সফল হয়। এসব বই কিছু সফল মানুষের কথা বলে কিন্তু সবাইকে ভালো রাখার মত একটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কথা বলে না; বর্তমান ব্যবস্থাটিকে পুনর্গঠন (Reform) করার কথা বলে না।

এইসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে সেল্ফ ডেভেলপমেন্ট-এর বইগুলো কিছু সস্তা পরামর্শ পাঠকদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় এবং কিছু অপরিপক্ক পাঠক একটা ঘোরের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করে। তবুও কিছু পাঠক এসব বই পড়ে উপকৃত হয়; এরা পরিশ্রম করতে শেখে এবং কিছু সাময়িক সাফল্যের দেখাও পায়। সেটা অন্যায় কিছু না।

কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে শুধু কিছু সাময়িক সাফল্যের পিছনে ছুটে শেষ পর্যন্ত আমরা একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকেই আরও পাকাপোক্ত করে তুলি।

/জেআর/