| |
               

মূল পাতা জাতীয় রাজনীতি হেফাজত থেকে আরও পদত্যাগ করছেন যারা


হেফাজত থেকে আরও পদত্যাগ করছেন যারা


সালমান তারেক শাকিল     25 April, 2021     01:35 AM    


মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ও নুরুল ইসলাম জিহাদীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম থেকে ইতোমধ্যে কয়েকজন দায়িত্বশীল আলেম পদত্যাগ করেছেন। এই পদত্যাগের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা সামনে আসবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে গত মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে, অন্তত ১৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে— এসব নাশকতার পেছনে জড়িত না থাকা ও বিচারের দাবিতে অন্তত এক ডজন হেফাজত নেতা পদত্যাগ করবেন। ইতোমধ্যে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে পদত্যাগে আগ্রহী অধিকাংশ নেতার আলাপ হয়েছে। এই আলাপে তারা হেফাজতে সক্রিয় থাকার বিষয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

পদত্যাগের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে হেফাজতের এই নেতারা জানান, গত মার্চে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, কিশোরগঞ্জের যেসব এলাকায় সহিংস ঘটনা ঘটেছে, এসব ঘটনার সঙ্গে তাদের সংযুক্ততা নেই। বিশেষ করে মাওলানা বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম কর্মসূচি পালনে হঠকারিতা প্রদর্শন করার কারণে তারা আর এই সংগঠনে থাকতে নিরুৎসাহিত বোধ করছেন। আর এ কারণেই হেফাজত ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নানাভাবে তথ্যও পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন আগ্রহী নেতারা।

হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এমন নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (কাসেমী অংশ)-এর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) নায়েবে আমির  মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মুফতি ওয়াক্কাছ অংশ) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, কেন্দ্রীয় সদস্য জমিয়তের (মুফতি ওয়াক্কাস অংশ) সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক, জমিয়তের (কাসেমী) সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা নাজমুল হাসান।

জানতে চাইলে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন, তারা কী কারণে করেছেন আমি জানি না। তবে আমি চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আছি। আমাকে তো ডাকেও না, আমি নিজেই যাই না।’ কী কারণে এমন হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে জাফরুল্লাহ খান বলেন, ‘হেফাজতের কার্যক্রম যেন কেমন হয়ে গেছে। কর্মসূচি যা দেওয়া হয়, তা অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছে।’

কেন হেফাজতের নায়েবে আমিরের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চান, এমন প্রশ্নে জাফরুল্লাহ খান বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফীর অন্তিমকালীন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, ওটা নিয়ে আলেমদের মধ্যে রক্তক্ষরণ আছে। ওই বেদনা এখনও জুড়ে আছে।’

পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক জমিয়তের (কাসেমী) সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমি তো সক্রিয় নই। আর ভবিষ্যতে কী হবে, এ নিয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন মনে করি না। ওয়েট অ্যান্ড সি।’

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের উভয় অংশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে জমিয়ত ওয়াক্কাছ গ্রুপ ও জমিয়ত কাসেমী গ্রুপের মিরপুর আরজাবাদ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক অংশটির মধ্যে একটি যুক্ততা তৈরি হয়েছে। শনিবার (২৪ এপ্রিল) বৃহত্তর মিরপুর কেন্দ্রিক হেফাজতের নেতারা সংগঠনটির নায়েবে আমির মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। একইভাবে জমিয়ত ওয়াক্কাছ গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ড. মহিউদ্দিন ইকরাম, দলের নেতা মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতা পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

জমিয়তের (মুফতি ওয়াক্কাছ) প্রভাবশালী এক নেতা রবিবার (২৫ এপ্রিল) বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বলেন, ‘দুই জমিয়তের বড় অংশ হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থার কারণে পদত্যাগের মানসিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে। একটি উগ্রপন্থী অংশ যেভাবে হেফাজতকে প্রভাবিত করেছে, তাতে এর বিকল্প নেই। আমরা খুব দ্রুতই প্রক্রিয়াটিকে সামনে আনবো।’

জানতে চাইলে জমিয়তের (মুফতি ওয়াক্কাছ) সিনিয়র নায়েবে আমির (হেফাজত-বাবুনগরী পন্থী কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য) মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা দলীয়ভাবেই ওই হেফাজতের সঙ্গে নেই। আমরা শুরু থেকেই আল্লামা আহমদ শফীর সাহেবের হেফাজতের সঙ্গে আছি। ভবিষ্যতেও থাকবো। ব্যক্তিগতভাবে কারও নাম মাওলানা বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে থাকলেও এটা তারাই বলতে পারবে কেন রেখেছেন। আমরা অতীতেও ছিলাম না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবো না।’

উল্লেখ্য, আহমদ শফীর মৃত্যুর পর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রয়াত সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস তার মৃত্যু ঘটনার তদন্ত চেয়েছেন ও বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দেন।

শনিবার (২৪ এপ্রিল) রাতে হেফাজতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় সংগঠনটির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সংগঠনের পরবর্তী স্টেপ কী হবে, তা আমির, মহাসচিব বলতে পারবেন। তবে আমি বলতে চাই, আমরা সংঘাত চাই না। কোনও পক্ষ থেকেই সংঘাত কাম্য নয়। ইতোমধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিশৃঙ্খলা হলে এর দায়ভার হেফাজত নেবে না। দেশের ভেতরে সংঘাত সৃষ্টি করলে তৃতীয় কোনও আধিপত্যবাদী দেশই সুযোগ পায়। ফলে, সরকারকে বলবো, সংঘাতের পথ পরিহার করুন। সংঘাত মঙ্গলজনক নয়।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একাধিক নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও হেফাজতের জেলা কমিটির আমির মাওলানা সাজিদুর রহমান, জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি মোবারক উল্লাহও পদত্যাগ করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে মাওলানা সাজিদুর রহমানের  ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

জেলা হেফাজতের একজন দায়িত্বশীল বলেন, ‘চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে, আলোচনাও চলছে। কারণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সব সময়ই প্রশাসনের সঙ্গে মুরুব্বিদের যোগাযোগ রয়েছে। কোনও সময়েই হঠকারী কর্মসূচি পালনে উৎসাহ প্রদর্শন করা হয়নি। সেদিক থেকে ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চ শহরে তাণ্ডব হয়েছে, এসবের অগ্রিম কোনও তথ্যই নেতাদের কাছে ছিল না। সেদিক থেকে বিষয়টি আমাদের কাছে একেবারেই নতুন।’

এছাড়া, ঢাকার আরজাবাদ, ফরিদাবাদ, চট্টগ্রামের মেখল, হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা পদত্যাগের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানা গেছে। মাওলানা আব্দুল হামিদ মধুপুরের পীরও হেফাজত ছাড়তে পারেন, এমন আলোচনা আছে।

এসব পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের উপদেষ্টা খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘আমি তো কোনও দায়িত্বে নাই। আমার নাম তারা উপদেষ্টা হিসেবে রেখেছে। আমি কখনোই হেফাজতের কোনও সভায় অংশগ্রহণ করিনি। আমি নিজে যাই না, উনারাও ডাকেন না। ফলে, কী হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারবো না। আমি অসুস্থ, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’

গত ১১ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেফতার শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত চার জনের সংগঠন ত্যাগের খবর পাওয়া গেছে। ১৩ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমিরের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি ও বাহাদুরপুরের পীর মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। তার অভিযোগ, আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন দল ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে হেফাজতে ইসলামকে অত্যন্ত সুকৌশলে ব্যবহার করেছে।

এর আগে মাওলানা বাবুনগরীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন আরেক নায়েবে আমির লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার সদরে মুদাররিস মাওলানা হাবিবুর রহমান। তার এক ঘনিষ্ঠ আলেম বলেন, ‘মাওলানা হাবিবুর রহমান জীবনেও কোনও মিছিলে যাননি। তিনি সার্বক্ষণিক শিক্ষক। ইতোমধ্যে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি হেফাজতে আর সক্রিয় নন।’

২২ এপ্রিল হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-অর্থ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা নাছির উদ্দিন। পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি কিছু লোকের প্ররোচনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাংগঠনিক পর্যায়ে যুক্ত হই। পরবর্তী পর্যায়ে দলের কিছু কর্মকাণ্ড আমাকে বিব্রত করে। তাদের মিছিল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্টের যে ঘৃণ্য কাজ, তা আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না।’ বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মাওলানা নাছির উদ্দিনের পর গত শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুফতি আব্দুর রহিম কাসেমী। সেখানে তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতে ইসলামের সব কার্যক্রম ও জাতীয় এবং জেলা কমিটির পদসমূহ থেকে পদত্যাগ করছি। যাদের প্ররোচনায় দেশ ও জনগণের জানমালের এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকার ও প্রশাসনকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।’

সরকারের প্রভাবশালী একটি সংস্থার সূত্র বলছে, হেফাজতের সাম্প্রতিক নাশকতায় যেসব আলেমের নাম নেই, তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কোনও নির্দেশনা নেই। তবে যারা সহিংসতায় মদদ দিয়েছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া, যারা হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানাবে, পদত্যাগে আগ্রহী, এ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়ন করবে সরকার।

হেফাজত নেতাদের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে রবিবার রাতে হেফাজতের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রেস সচিব মাওলানা ইন'আমুল হাসান ফারুকী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত হেফাজত থেকে দুই জন পদত্যাগ করেছেন। একজন মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান ও মাওলানা আব্দুর রহিম কাসেমী। মাওলানা রহিমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় লোকেরাই হেফাজতে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু যখন জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে নৈতিক স্খলনের কারণে তাকে বের করে দেওয়া হয়, তখন হেফাজত থেকেও বাদ পড়েছেন তিনি। আর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান তো সক্রিয় ছিলেন না। তিনি সর্বশেষ মিটিংয়েও আসেননি। এই দুজনের কথাই জানি।’
-বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে